শিক্ষামূলক গল্প: দাসত্বের অবসান
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্রীতদাস ব্যবসা একটি সমৃদ্ধশালী এবং খুব
বড় ব্যবসা ছিল। বিশিষ্ট পরিবারগুলি দাস ব্যবসায় ও স্বার্থ ধরে রেখেছিল, মানুষের এক
বিশাল অংশ তাদের জীবিকার জন্য দাসত্বের উপর নির্ভর করত আর এতে মানুষের মতামত ছিল নিরুপদ্রব।
ইংরেজ দাসপ্রথার অবসানকারী টমাস ক্লার্কসন যখন দাসত্ব বাণিজ্যের বিরোধিতা করে খ্রিস্টিয়
বিশ্বাসীদের দল কোয়েকারদার সাথে যোগ দেন তখন সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল আপাতদৃষ্টিতে খুবই
ক্ষীণ।
২২ মে, ১৭৮৭ সালে ক্লার্কসন এবং আরও ডজনখানেক মানুষ জেমস ফিলিপ বুকস্টোরে
দাস বাণিজ্য কমিটির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। তারা দাস বাণিজ্য সম্পর্কে তথ্য
সংগ্রহ করার মাধ্যমে, প্যাম্ফলেট, পোস্টার এবং জনগণের কাছে বক্তৃতা দিয়ে দাস বাণিজ্যের
অমানবিকতা প্রকাশ করে এবং ব্রিটিশ দাস বাণিজ্য নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন তৈরি করার
জন্য এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ক্লার্কসন তাদের একমাত্র পূর্ণ সময়ের দাসত্ববিরোধী
প্রচারক হয়ে ওঠেন। তিনি দাস ব্যবসার উপর তথ্য সংগ্রহ করতে এবং এর নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার
প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সারা ইংল্যান্ডে নিরলসভাবে ভ্রমণ করেছিলেন।
কাজটি অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন ছিল। দাসত্ব ব্যবসার সাথে জড়িতদের মধ্যে খুব
কমই তার সাথে কথা বলত; তিনি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন, এবং অন্তত একবার মেরে ফেলার
প্রচেষ্টা করেছিল; অনেকে তাকে উপহাস করেছিল। সেই প্রথম বছরে তিনি উল্লেখ করেন “সেই
সময়ে আমার সামনে বিশাল জায়গায় গড়ে উঠা দাস বাণিজ্যের একটি শাখাকে ধ্বংস করার যে কঠিন
কাজটি হাতে নিয়েছিলাম তার কারণে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি তার জন্য আমি এখন কাঁপতে
শুরু করেছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম সেখান থেকে জীবিত বের হওয়া যাবে কিনা।
তথাপি মানুষের মতের জোয়ার দিক পরিবর্তন হতে থাকে। হাজার হাজার নামের
পিটিশন সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। আরও অনেক লোক এই কারণের সাথে যুক্ত হয়েছিল, যার মধ্যে ছিলেন
কুমার জোসিয়া ওয়েজউড, যিনি “আমি কি একজন মানুষ এবং ভাই নই? সম্বলিত বাক্য দিয়ে কাঠে
খুদাই করে হাটুঁগেড়ে বসা এক দাসের নকশা তৈরি করেছিলেন যা একটি জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী
অলঙ্করণে পরিণত হয়, আর সংসদ সদস্য উইলিয়াম উইলবারফোর্স সংসদে দাসত্ব বাণিজ্যের বিরুদ্ধে
আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। হাজার হাজার মানুষ দাসদের দ্বারা ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য
চিনি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয়, আর দাস-মুক্ত চিনি আসতে শুরু করে। নাইজেরিয়ান স্বাধীন, ওলাউডা ইকোইয়ানু
(Olauda Equiano)’র আত্মজীবনীমূলক বই বেস্ট সেলার হয়ে ওঠে এবং অনেকে তাকে কথা বলতে
শুনেছিল।
জেমস ফিলিপ বইয়ের দোকানে প্রথম বৈঠকের পাঁচ বছরের মধ্যে জনমত দাস বাণিজ্যে
বিরুদ্ধে পরিণত ঘনীভূত হয়। যদিও সংসদকে জয় করতে আরও বেশি সময় লেগেছিল। উইলিয়াম উইলবারফোর্স
ছিলেন সংসদীয় প্রচারণার প্রধান ।
এত বিশাল, এত ভয়ংকর, আর দাস বাণিজ্যের মন্দতা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে
দেখা দিয়েছিল যে আমার নিজের মন সম্পূর্ণরূপে দাস বাণিজ্য বিলুপ্তির জন্য তৈরি হয়েছিল।
তার পরিণতি যা হবে তাই হোক; আমি এই সময় থেকে মনস্থির নিয়েছিলাস যে আমি এই দাস বাণিজ্যের
বিলুপ্তি কার্যকর না করা পর্যন্ত আমি কখনই বিশ্রাম নেব না।
ক্লার্কসনের মতো, উইলবারফোর্সও প্রচণ্ড বিরোধিতা এবং উপহাসের মুখোমুখি
হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ব্রিটিশ রয়াল নেভি অ্যাডমিরাল হোরাটিও নেলসন সেই আন্দোলনকে,
“উইলবারফোর্স এবং তার কপট মিত্রদের জঘন্য মতবাদ” বলে নিন্দা করেছিলেন।
তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিটের মতো সহকর্মীদের সমর্থনও পেয়েছিলেন।
দাস বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সকল প্রস্তাবনা ১৭৯১, ১৭৯২ম ১৭৯৩, ১৭৯৭, ১৭৯৮,
১৭৯৯, ১৮০৪ ও ১৮০৫ ব্যর্থ হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৭ পর্যন্ত যখন দাস বাণিজ্য বিলুপ্তির
জন্য সংসদে একটি আইন ২৮৩-১৬ ভোটে পাস হয়েছিল।
দাসপ্রথা বিরোধী কর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন যে যদি কোনোভাবে একবার জাহাজে
করে দাসদের আনা-নেওয়াকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় তাহলে দাসপ্রথা ভেঙে পড়বে। এই অনুমান
ছিল খুবই কাঁচা। আর কোনো ক্রীতদাস নিয়ে আসা না হলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ব্রিটিশ মালিকানাধীন
বাগানে ক্রীতদাসদের ধরে রাখা হয়েছে এবং তাদের সন্তানদের ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছিল।
আর তার কারণে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৮৩১ সালের ক্রীতদাসদের গণ-অভ্যুত্থান ইঙ্গিত দেয়
যে ক্রীতদাসদের নিপীড়ন আর বজায় রাখার মতো ছিল না এবং ১৮৩৩ সালে দাসপ্রথা মুক্তি আইন
অবশেষে ব্রিটিশ দাসত্বের অবসান ঘটায়।
এ দাসপ্রথার অবসান ঘটাতে ৫৬ বছর লেগেছিল, কিন্তু কে ভেবেছিল যে ২২ মে,
১৭৮৭-এ জেমস ফিলিপ বুকস্টোরে ডজন খানেক লোকের সেই বৈঠক থেকে কোনো প্রস্তুত ছাড়া তাদের
দৃঢ়তা আর কথা এমন ফলাফলের জন্ম দেবে? সত্য-ন্যায় ও ন্যায়পরায়ণতার পক্ষে দাঁড়িয়ে চাইলে
একজন মানুষ হাজার মানুষের মতামত বদলে দিয়ে ইতিহাসের পটভূমি পরিবর্তন করতে সক্ষম।