আমেরিকা এবং এর মিত্ররা ২০০১ সালে তালেবানকে উৎখাত করার পর, আফগান মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ০% থেকে বেড়ে ৮০% এর উপর বৃদ্ধি পায়। শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। জোরপূর্বক বিবাহকে অবৈধ করা হয়েছিল। সেই স্কুলগুলির মধ্যে অনেকগুলি ছিল জরাজীর্ণ, এবং অনেক পরিবারই এই আইন অমান্য করেছিল। কিন্তু কেউই গভীরভাবে সন্দেহ করেনি যে আফগান নারী ও মেয়েরা গত ২০ বছরে কতটা অনেক সফলতা অর্জন করেছে, অথবা সেইসব অর্জন এখন বিপদের সম্মুখীন।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মতে, পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র “লৈঙ্গিক সমতা উন্নয়নে বদ্ধপরিকর”। একদল হিংস্র নারীবিদ্ধেসীর কাছে বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র আর একটি মাঝারি আকারের দেশকে দান করে দেওয়াটা এই নীতি প্রদর্শনের এক অদ্ভুত উপায়। অবশ্যই, বৈদেশিক নীতির সাথে কঠোর বাণিজ্য-বিনিময়ের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এক দশক আগে হিলারি ক্লিনটনের কথা “নারীদের পরাধীনতা.. আমাদের বিশ্বের সাধারণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি” প্রমাণ করছে যে তিনি তার মাধ্যমে কিছু একটা বুঝাতে চেয়েছিলেন। যে সমাজ নারীদের নিপীড়ন করে সে সমাজ অনেক বেশি হিংস্র এবং অস্থির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। অনেক জায়গায় মেয়েদের বেছে বেছে গর্ভপাত করা হয় বা মারাত্মকভাবে অবহেলা করা হয়। এর ফলে লৈঙ্গিক অনুপাত হয়ে উঠছে অসম, যার কারণে লক্ষ লক্ষ যুবক কে অবিবাহিত থাকতে হয়। হতাশ যুবকদের হিংস্র অপরাধ করার বা বিদ্রোহী দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বোকো হারাম এবং ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি দলগুলি তা ভালভাবেই জানে, আর তাই তারা তাদের গনিমতের মাল বা যুদ্ধের মাল হিসেবে “একাধিক স্ত্রী”র প্রতিশ্রুতি দেয়। বহুবিবাহ অবিবাহিত যুবকদের একটি উদ্বৃত্তও সৃষ্টি করে। উপরের পর্যায়ের পুরুষদের জন্য একাধিক স্ত্রী মানে নিম্ন পর্যায়ের পুরুষদের জন্য কৌমার্য লালন করা।
সমস্ত দ্বন্দ্বের জটিল কারণ থাকে। কিন্তু ভারতের কাশ্মীরের সবচেয়ে বেশি ভারসাম্যহীন যৌন অনুপাতের ঘটনা কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না, অথবা ওয়াশিংটনের ফান্ড ফর পিস অনুযায়ী ভঙ্গুর রাষ্ট্র সূচক অনুযায়ী যে ২০টি সবচেয়ে অস্থিতিশীল দেশে বহুবিবাহ অনুশীলন করা হয় তাকেও কাকতালীয় ঘটনা বলা যাবে না । গিনিতে, যেখানে ৫ সেপ্টেম্বর একটি সেনা অভ্যুত্থানের সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশই বহুগামী সম্পর্কে জড়িত। চীনের পুলিশিরাষ্ট্র অনেক উদ্বৃত্ত পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে রাখছে, কিন্তু প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে ভাবতে থাকে যে তাদের আগ্রাসন কোন একদিন অনুভূতি বহিঃপ্রকাশের সুযোগ খুঁজতে পারে কিনা।
সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের বাইরে, পুরুষ আত্মীয়তা গোষ্ঠী এখনও অনেক সমাজের মৌলিক একক। এই জাতীয় গোষ্ঠী সমূহ মূলত আত্মরক্ষার জন্য আবির্ভাব হয়েছিল: পুরুষ কাজিনরা বহিরাগতদের প্রতিহত করার জন্য একত্রিত হত। আজ, তারা বেশিরভাগই সমস্যা সৃষ্টি করে। “ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়” এমন বংশগত দ্বন্দ্ব মধ্য প্রাচ্য এবং বার্কিনা পাসু’র সাহের জুড়ে রক্ত ছড়ায়। প্রায়শই হিংস্রভাবে উপজাতিরা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিযোগিতা করে, যাতে তারা চাকরি ভাগ করতে পারে এবং তাদের আত্মীয়দের মাঝে লুট করতে পারে। সেই সব রাষ্ট্র নাগরিকদের বিচ্ছিন্ন করে এবং অপেক্ষাকৃত ন্যায়সঙ্গতভাবে শাসন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া জিহাদিদের সমর্থন বাড়িয়ে হয়ে উঠেছে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অকার্যকর।
পুরুষ বন্ধন-ভিত্তিক সমাজের মাঝে নারীদের বশীভূত করার প্রবণতা রয়েছে। সেখানে বাবারা তাদের মেয়েরা কাকে বিয়ে করবে তা নির্বাচন করে দেয়। প্রায়শই সেখানে সম্পৃক্ত থাকে কনের মূল্য – যা বরের পরিবার কাছ থেকে কনের পরিবারকে পরিশোধিত মোটা অঙ্কের একটি অর্থ। অর্থের সাথে সম্পৃক্ত এই সুবিধার কারণে বাবারা তাদের মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে উৎসাহী হয়ে উঠে। এটি কোনো একটি ছোট-খাট সমস্যা নয়। পৃথিবীর অর্ধেক দেশে এই যৌতুক বা কনের মূল্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। পৃথিবীর ১পঞ্চমাংশের তরুণী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে; যাদের বিশ ভাগের এক অংশের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সে। মেয়ে শিশুদের মাঝে স্কুল থেকে ছিটকে পড়ার যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বেশি, যারা তাদের নির্যাতনকারী স্বামীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কম সক্ষম এবং তাদের পক্ষে সুস্থ, সুশিক্ষিতভাবে ছেলে-মেয়ে বড় করে তোলার সম্ভাবনা কম।
Texas A&M and Brigham Young বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মহিলাদের প্রতি প্রাক-আধুনিক মনোভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সূচক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে, যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যৌনবৈষম্যবাদী (sexist) পরিবার আইন, অসম সম্পত্তির অধিকার, অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ, patrilocal বা বিয়ের পর স্বামীর পরিবারে বসবাস করা বৈবাহিক প্রথা, বহুবিবাহ, কনের মূল্য বা যৌতুক, ছেলে সম্পর্কে বিশেষ পছন্দ, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সহিংসতার প্রতি আইনগত অবহেলা (যেমন, একজন ধর্ষক কি ধর্ষণের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীকে বিয়ে করে শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে?)। এটি একটি দেশের সহিংস অস্থিতিশীলতার সাথে অত্যন্ত সম্পর্কযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এ গবেষণা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। তাদের স্বাভাবিক বিশ্লেষণমূলক উপাদানের পাশাপাশি, নীতিনির্ধারকদের উচিত লৈঙ্গিক প্রিজমের মাধ্যমে ভৌগলিক রাজনীতি অধ্যয়ন করা। যৌনবৈষম্যবাদী রীতিনীতির সেই সূচকটি যদি ২০ বছর আগে বিদ্যমান থাকত, তাহলে আফগানিস্তান এবং ইরাকে জাতি-গঠন কতটা কঠিন হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের সতর্ক করা যেতো। আজ, তা আমাদের দেখায় যে সৌদি আরব, পাকিস্তান বা এমনকি ভারতের স্থিতিশীলতাকে নিরঙ্কুশভাবে গ্রহণ করা যায় না।
শান্তি আলোচনায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ১৯৯২ এবং ২০১৯ এর মধ্যে, আলোচকদের কেবল ১৩% এবং শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ৬% মহিলা ছিল। তবুও নারীরা যখন আলোচনা টেবিলে থাকে তখন শান্তি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর কারণ হতে পারে যে তারা আপোষের বেলায় অধিকতর প্রস্তুত; অথবা সম্ভবত এই কারণে যে মহিলাহীন কোনো কক্ষ মানে বে-সামরিক লোকদের কাছ থেকে কোন ধরনের জোগান ছাড়া বন্দুকধারী পুরুষদের মধ্যে একতরফা চুক্তি করা। লাইবেরিয়া নারীদের প্রতি এই অধিকার পেয়েছে আর একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে; আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের কাছে তা নেই।
আরও বিস্তৃতভাবে বলতে হলে, সরকার যখন বলে যে দেশের অর্ধেক মানুষকে তারা স্বাধীন করতে আগ্রহী, তখন তা বাস্তবায়নে সরকারকে বদ্ধপরিকর হওয়া চায়। যেসব মেয়েরা কাজ করার জন্য বা কোভিড-১৯’র প্রভাবে তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর যেসব মেয়েরা কাজ করার জন্য বা বিয়ে করার জন্য স্কুল ছেড়ে দিয়েছে তাদের শিক্ষিত করে তুলুন। বাল্যবিবাহ এবং মেয়েদের যৌনাঙ্গ বিকৃতি বা খৎনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করুন, প্রত্যন্ত গ্রামে তা যদিও অনেক কষ্টকর। বহুবিবাহকে স্বীকৃতি দেবেন না। উত্তরাধিকার অধিকারে সমতা বিধান নিশ্চিত করুন। ছেলেদের শেখান তারা যেন নারীদের আঘাত না করে। গণ-ভাতা প্রবর্তন করুন, তা বয়স্কদের কাছে সহায়তার অন্য কোন উপায় না থাকার কারণে, কোনো দম্পতিকে কোনো পুরুষের বাবা-মার সাথে বসবাস করার প্রথাকে ক্ষুণ্ণ করে।
এর অধিকাংশই জাতীয় সরকারের কাজ, কিন্তু বহিরাগতদেরও কিছু প্রভাব রয়েছে। পশ্চিমা দাতারা যখন থেকে মেয়েদের শিক্ষার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া শুরু করে, তখন থেকে অধিক মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে (প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১৯৭০ সালের ৬৪% থেকে বেড়ে আজ প্রায় ৯০% হয়েছে)। ২০০০ সাল থেকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানকারীরা ৫০টিরও বেশি দেশকে নূন্যতম বয়স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে। ছেলেদের উচিৎ স্থানীয় পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে অসহিংসতা সম্পর্কে জানা, কিন্তু এই ধরনের কর্মসূচি সজ্জিত করার উপায় সম্পর্কে ধারনা বিশ্বব্যাপী দাতব্য সংস্থা এবং থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের মাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছে। USAID এবং বিশ্বব্যাংকের মতো দাতারা নারীদের সম্পত্তি অধিকার বাস্তবায়ন প্রচারে বেশ ভালো কাজ করেছে, যদিও তাদের আফগান প্রচেষ্টা অনেকটা ধোঁয়াশা হয়ে যাওয়ার পথে।
সেক্স ও ভূ-রাজনীতি: মৌলিক ধারণা
পররাষ্ট্র নীতি কাঁচা হওয়া উচিত নয়। সকল দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে, আর শত্রুদের প্রতিহত করা প্রয়োজন। ভৌগলিক রাজনীতিকে শুধুমাত্র এক নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়, যেমনটা উচিৎ নয় একে অর্থনীতিক বা পারমাণবিক বিস্তারনিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিতে দেখা। কিন্তু যেসব নীতিনির্ধারকরা অর্ধেকটা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয় তারা বিশ্বকে বোঝার আশা করতে পারে না।
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ The Economist এ প্রকাশিত সেক্স ও ভূ-রাজনীতি: Why nations that fail women fail এর বাংলা অনুবাদ)