কাঁটাতারের বাইরে তিনজন মানুষকে দাফন করার আদেশ দেওয়া হলো আমাদের। শিবিরে কেবল আমাদের দুজনেরও সে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি ছিল। প্রায় সবাই তখনও ব্যবহৃত হওয়া কয়েকটি ছাউনিতে জ্বর আর প্রলাপ বিকারের কারণে শুয়ে থাকছিল। আমরা আমাদের পরিকল্পনা করেছিলাম যে, প্রথমে লাশের সাথে আমরা কফিন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ধোলাইখানার টবের ভেতর লুকিয়ে আমার বন্ধুর কাঁদ-ব্যাগটি পার করবো। দ্বিতীয় লাশটি বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আমার কাঁদ-ব্যাগটিও বহন করে নিয়ে যাবো, আর তৃতীয় যাত্রায় আমরা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবো। প্রথম দু’যাত্রা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছিল। ফিরে এসে পরবর্তী কয়েকদিন জঙ্গলে খাওয়ার জন্য আমার বন্ধু যখন একটুকরো রুটির সন্ধান করছিল তখন আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি অপেক্ষা করেই চলছিলাম। কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলো। তার ফিরে না আসাতেই আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। তিন বছর বন্দীদশার পর, আমি আনন্দের সাথে মুক্তির চিত্র আঁকছিলাম, যুদ্ধক্ষেত্রের পানে ছুটে যাওয়া কতোটা অপূর্ব হতে পারে তা কল্পনা করছিলাম। কিন্তু আমরা ততদূর যেতে পারিনি, আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।
যখন আমার বন্ধু ফিরে আসে তখন শিবিরের প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়েছিল। অ্যালুমিনিয়াম রঙ্গের চমৎকারে একটি কার, যাতে বড় করে রেডক্রস অঙ্কিত ছিল, ধীরে ধীরে কুচকাওয়াজ মাঠে অগ্রসর হয়। জেনেভার আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একজন প্রতিনিধি এসে পৌঁছেছিলেন, আর শিবির ও এর কয়েদীরা এখন তার আশ্রয়ে। প্রতিনিধিটি নিকটস্থ এক খামারবাড়িতে বাস করতে শুরু করেছিলেন যাতে জরুরী পরিস্থিতিতে সবসময় শিবিরের কাছাকাছি থাকতে পারেন। পালিয়ে যাওয়ার কথা এখন কে চিন্তা করে? গাড়ি থেকে ঔষধের বাক্সগুলি নামিয়ে আনা হলো, সিগারেট বণ্টন করা হলো। আমাদের ছবি তুলা হলো আর তখন আমাদের আনন্দ সর্বাত্মক রাজত্ব করেছিল। এখন যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে পলায়ন করে ঝুঁকি নেওয়া কোনো প্রয়োজন ছিলনা।
আমাদের উত্তেজনার বশে তৃতীয় লাশটির কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। লাশটি বহন করে বাইরে নিয়ে গিয়ে তিনজনের জন্য ইতিমধ্যে খুড়ে রাখা কবরে তাকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমাদের সাথে থাকা যে প্রহরীটি তুলনামূলকভাবে একজন অমানবিক লোক ছিলেন—হঠাৎ করে তিনি শান্ত-ভদ্র হয়ে গেলো। তিনি লক্ষ্য করলেন যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে আর তাই তিনি অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মৃত ব্যক্তিদের উপর মাটি ছিটিয়ে দেওয়ার আগে তাদের জন্য আয়োজিত সংক্ষিপ্ত প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিগত দিন ও মুহূর্তের চিন্তা আর উত্তেজনার পর মৃত্যুর সাথে দৌড়ের সেই শেষ দিনগুলিতে শান্তি কামনায় আমাদের প্রার্থনার ভাষা ছিল কখনও কোনো মানব কণ্ঠে উচ্চারিত ভাষার মতোই আকুলতাপূর্ণ।
আর তাই শিবিরের শেষ দিনগুলি মুক্তির অপেক্ষায় কাটে। কিন্তু আমরা খুব আগ থেকেই আনন্দিত হয়ে পড়েছিলাম। রেডক্রস প্রতিনিধি আমাদের নিশ্চিত করেছিলেন যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, এবং তাই শিবির খালি করে দেওয়ার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও সেই রাতে ট্রাক আর শিবির খালি করার আদেশ নিয়ে SS কর্মীদের আগমন ঘটেছিল। অবশিষ্ট শেষ বন্দীদের একটি কেন্দ্রীয় শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলো, যেখান থেকে তাদেরকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু যুদ্ধবন্দীর সাথে বিনিময় হওয়ার জন্য সুইৎযারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমরা SS কর্মীদের সহজে চিনতে পারিনি। তারা খুবই বন্ধুসূলভ আচরণ করতে শুরু করে, নির্ভয়ে আমাদের ট্রাকে উঠার জন্য বোঝাতে থাকে, আর বলেছিল যে আমাদের সৌভাগ্যের জন্য আমাদের অবশ্যই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ।
যারা মোটামুটি শক্তিশালী ছিল তারা ভিড় করে ট্রাকে উঠে পড়ে আর গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বলদের কষ্ট করে তুলা হয়েছিল। আমি ও আমার বন্ধু এখন আমাদের কাঁদ-ব্যাগ লুকিয়ে না রেখে, শেষ দলে দাঁড়িয়েছিলাম। যে দলটি থেকে পরবর্তী শেষ ট্রাকের জন্য তের জনকে বেছে নেওয়ার কথা। প্রধান চিকিৎসক প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি শব্দ করে গণনা করলেন, কিন্তু গনগনায় তিনি আমাদের দুজনকে বাদ দিলেন। তের জনকে ট্রাকে তুলা হলো, আর আমরা দুজনকে পেছনে থেকে রয়ে যেতে হয়েছিল। বিস্মিত, খুব বিরক্ত আর হতাশ হয়ে আমরা তার জন্য প্রধান চিকিৎসককেই দায়ী করেছিলাম। ক্লান্ত এবং অমনোযোগী হওয়ার কারণে এ ঘটনা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন আমরা হয়তো তখনও পালিয়ে যাওয়ার জন্য সংক্ল্পবব্ধ ছিলাম, তাই তিনি তাদের বাদ দিয়েছিলেন। কাঁদ-ব্যাগ কাঁদে রেখে অধৈর্য হয়ে আমরা বসে পড়লাম, আর বাকী কয়েকজন বন্দীদের সাথে শেষ ট্রাকে অপেক্ষায় থাকি। দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। শেষ কয়েক ঘনটা আর কয়েকদিনের উত্তেজনায় ভারাক্রান্ত হয়ে অবশেষে আমরা পরিত্যক্ত প্রহরী কক্ষের মেট্রেসের উপর শুয়ে পড়েছিলাম। এই সময়ে আমরা আশা-নিরাশার মাঝে অবিরতভাবে দোলতে থাকি। যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জুতা-কাপড়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
রাইফেল আর কামানের শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ট্রেসার বুলেটের আলো ও বন্দুকের গুলাগুলি ছাউনিতে ডুকে পড়ে। প্রধান চিকিৎসক সবেগে ডুকে আমাদের মেঝেতে আশ্রয় নেওয়ার আদেশ দেন। এক কয়েদী জুতো পড়া অবস্থায় আমার উপরে অবস্থিত বিছানা থেকে আমার পেটের উপর লাফ দেয়। তা আমাকে আসলেই জাগিয়ে তুলেছিল! তারপর আমরা কি ঘটছিল তা অনুধাবন করতে পারি: যুদ্ধক্ষেত্র আমরা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল! গুলাগুলি কমে যায় এবং সকাল নেমে আসে। বাইরে শিবিরের প্রবেশদ্বারে খুঁটিতে একটি সাদা পতাকা বাতাসে উড়ছিল।
**********
অনেক সপ্তাহ পর বুঝতে পারি যে, এমন কি সেই শেষ কয়েক ঘণ্টাতেও আমরা বাকি কয়েকজন কয়েদীর সাথে নিয়তি খেলা করেছিল। আমরা বুঝতে পারি মানুষের সিদ্ধান্ত কতটা অনিশ্চিত, বিশেষ করে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে। আমাদের আদুরে অবস্থিত ছোট শিবিরে তুলা ছবিগুলি আমার সামনে আনা হয়েছিল। আমার যে বন্ধুরা সে রাতে ট্রাকে করে সেই ছোট শিবিরে মুক্তির দিকে যাত্রা করছে ভেবেছিল, সেখানে তাদের ছাউনিতে বন্দী করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ছবিতে তাদের দগ্ধ দেহগুলিকে চেনা যাচ্ছিল। আমার পুনরায় তেহরানে মৃত্যু বা Death in Tehran কাহিনীটির কথা মনে পড়লো।
************
প্রতিরক্ষামূলক কৌশল ভূমিকা ছাড়াও, কয়েদীদের উদাসীনতা অন্য উপাদানেরও ফসল। সাধারণ জীবনের মতো ক্ষুধা, ঘুমের অভাব উদাসীনতা ও সাধারণ বিরক্তি বোধের কারণ হয়ে উঠেছিল, যা কয়েদীদের মানসিক অবস্থার আরেক বৈশিষ্ট্য। ভয়াবহরুপে জনাকীর্ণ ছাউনিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর স্বাস্থ্য বিধানের সাধারণ অভাবে কীট-পতঙ্গের উপদ্রবের জালাতনই ঘুমের অভাবের জন্য কিছুটা দায়ী। আমাদের কাছে কোনো ধরনের বিড়ি-সিগারেট বা চা-কফি না থাকাও উদাসীনতা এবং বিরক্তিবোধ অবস্থা সৃষ্টির কারণ।
উদাসীনতা এবং বিরক্তিবোধের এসব শারীরিক কারণের পাশাপাশি, নির্দিষ্ট কিছু জটিল ধরনের মানসিক কারণও বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ কয়েদীই এক ধরনের হীনমন্যতা জটিলতায় ভুগছিল। আমরা সবাই “বিশেষ কোনো ব্যক্তি” হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম বা দেখেছিলাম। এখন আমাদের সাথে সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব, অবস্তু বা অসত্তা হিসেবে আচরণ করা হচ্ছে। কারো আভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের চেতনা উচ্চতর, বৃহত্তর আধ্যাত্মিক উপাদানে নোঙর বদ্ধ, আর তাকে শিবির জীবন-যাপনের মাধ্যমে নাড়ানো অসম্ভব। কিন্তু কয়েদি তো দুরের কথা, কয়জন স্বাধীনচেতা মানুষ তা লাভ করতে পারে? তাকে কেন্দ্র করে সচেতন চিন্তা ব্যতীত একজন সাধারণ বন্দী নিজেকে নিতান্তই মর্যাদাহীন অনুভব করতো। শিবিরের একক সমাজতাত্ত্বিক কাঠামোর দ্বারা প্রস্তাবিত বৈসাদৃশ্যগুলি পর্যবেক্ষণ করলে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। নিয়ম অনুযায়ী সুপরিচিত কয়েদীরা, যেমন ক্যাপু, রাঁধুনি, গুদাম ঘরের পাহারাদার, এবং শিবিরের পুলিশেরা কোনোভাবেই অধিকাংশ বন্দীদের মতো এতো মর্যাদাহীন অনুভব করেনি, বরং উল্টো তাদের পদোন্নতি দেওয়া হতো! এমনকি কেউ কেউ ক্ষুদ্রাকার মহিমা-বিভ্রম গড়ে তুলেছিল। অনুগ্রহপ্রাপ্ত এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ঈর্ষান্বিত ও অসন্তুষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার হরেক রকম উপায় ছিল। অনেক সময় রসিকতার মাধ্যমে হয়ে থাকতো। উদাহরণ সরূপ, একজন বন্দীকে আমি এক ক্যাপুর ব্যাপারে বলতে শুনেছিলাম, “চিন্তা করতে পারো”! কেবল বড় এক ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি লোকটিকে চিনতাম। এটা কি সৌভাগ্যের বিষয় নয় যে পৃথিবীতে সে অনেক উচ্চতায় পৌঁছেছে”?
মর্যাদাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পদোন্নতি পাওয়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তার ফলাফল হতো বিস্ফোরক রকমের। অতএব, এসব মানসিক চাপ যুক্ত হয়ে সাধারণ বিরক্তি বোধ হয়ে উঠত সবচেয়ে তীব্রতর। প্রায়শই এই মানসিক চাপ সাধারণ মারামারিতে রূপ নেওয়াটা অবাক করার কিছু ছিলনা। কারণ একজন কয়েদি ক্রমাগতভাবে প্রহারের দৃশ্য দেখতে দেখতে সহিংসতার প্রতি তার তাড়না বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় আমার উপর ক্ষোভ ভর করলে আমি টের পায় আমার ঘুসি দৃঢ় মুষ্টিতে পরিণত হতে। আমি সাধারণত খুবই ক্লান্ত থাকতাম, কারণ আমাদেরকে সারা রাতজুড়ে চুলার আগুনে কাঠ সরবরাহ দিতে হতো। টাইফাস রোগীদের কারণে আমাদের ছাউনিতে একটি চুলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সবচেয়ে অলস ঘণ্টাগুলি আমি পেয়েছিলাম মধ্যরাতে যখন অন্যরা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকতো বা ঘুমিয়ে থাকতো। চুলার সামনে আমি সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে পারতাম এবং চুরি করা কয়লা থেকে সৃষ্ট আগুনে চুরি করে আনা কয়েকটি আলু তাতে সেক দিতাম। কিন্তু পরদিন আমি সবসময়ই আরও অধিক ক্লান্ত, অনুভূতিহীন ও বিরক্তি অনুভব করতাম।
*********
টাইফাস রোগীদের ঘরে আমি যখন একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলাম, তখন আমাকে অসুস্থ সিনিয়র ব্লক ওয়ার্ডেনের কাজও করতে হয়েছিল। তাই শিবির কর্তৃপক্ষের নিকট ছাউনি পরিষ্কার রাখার বিষয়ে আমি দায়বদ্ধ ছিলাম- যদি আদৌ “পরিষ্কার” শব্দটি এরকম পরিস্থিতিকে বর্ণনায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে থাকে। ছাউনিতে ঘন ঘন পরিদর্শনের ছুতোর পেছনে স্বাস্থ্যবিধির চেয়ে জালাতনের উদ্দেশ্যেই ছিল বেশী। আরও একটু খাবার এবং কয়েকটি ঔষধই যেখানে বেশি সহায়ক হতো, সেখানে পরিদর্শকদের উদ্বেগ ছিল কেবলই গলির মাঝখানে কোনো স্ট্র ফেলে যাওয়া হলো কিনা , কিম্বা ময়লা , জীর্ণ এবং রোগীদের কীট-পতঙ্গে আক্রান্ত কম্বলগুলি নিখুঁতভাবে তাদের পায়ের সাথে গুঁজিয়ে দেওয়া হলো কিনা তা নিয়ে। কয়েদিদের নিয়তির বেলায় তারা ছিল বেশ বিবেচনাহীন। আমার নেড়া মাথা থেকে আমার কয়েদী টুপিতে আঘাত করতে করতে এবং আমার পায়ের গোড়ালি দিয়ে জোতার ক্লিক শব্দ করে যদি আমি চটপটে হয়ে রিপোর্ট করতাম,“ছাউনি নাম্বার ৬/৯, ৫২ জন রোগী, দু’জন সেবক বেয়ারা, ও একজন চিকিৎসক”, তাতে পরিদর্শকেরা সন্তুষ্ট হতো। তারপর তারা চলে যেতো। অনেক সময় তারা ঘোষিত সময়ের চেয়ে কয়েক ঘণ্টা দেরি করতো বা অনেক সময় আসতই না। কিন্তু যতক্ষণ না তারা এসে পৌঁছেছে ততোক্ষণ আমাকে জোর করে কম্বলগুলি সোজা রাখতে, বাঙ্ক বিছানা থেকে পড়া স্ট্রটি কুড়িয়ে নিতে, বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকা বেচারা দুষ্টদের চিৎকার করে এবং পরিপাটি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় আমার সমস্ত প্রচেষ্টাকে লণ্ডভণ্ড করার হুমকি দিয়ে যেতে হতো। জ্বরের রোগীদের কাছে উদাসীনতা মাত্রা ছিল বিশেষত চড়া, তাই চিৎকার করা ছাড়া তারা একেবারেই কোনো সাড়া দিত না। অনেক সময় তাতেও কাজ হত না, আর তখন তাকে আঘাত না করার জন্য প্রচণ্ড আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োজন হতো। কারণ নিজের বিরক্তি বোধ অন্য জনের উদাসীনতার মুখোমুখি হয়ে অনেক অনুপাতে বেড়ে যেতো, বিশেষত আসন্ন পরিদর্শনের মতো বিপদের মুখোমুখি হলে।
*********
বন্দী শিবিরের বন্দীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সমূহের এই মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপনা এবং সাইকোপ্যাথোলজিকাল ব্যাখ্যা প্রদানের প্রচেষ্টায়, আমি এই ধারণাটি দিতে পারি যে, মানুষ তার চারপাশ দ্বারা সম্পূর্ণ এবং অনিবার্যভাবে প্রভাবিত। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকতা হলো শিবির জীবনের অনন্য কাঠামো, যা একজন কয়েদির আচরণকে নির্দিষ্ট এক আকৃতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় বাধ্য করতো। তাহলে মানব মুক্তির কোনো উপায় আছে? আচরণের ক্ষেত্রে কিম্বা নির্দিষ্ট কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়ার বেলায় কি কোনো আধ্যাত্মিক মুক্তি নেই?
মানুষ যে অনেক শর্তাধীন ও পরিবেশগত উপাদানের ফলাফল ব্যতীত কিছু নয় এমন ধারনা দেওয়া তত্ত্বটি কি সত্য – হোক তা জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক প্রকৃতির? মানুষ কি এসবের দৈব ফলাফল ছাড়া আর কিছুই নয়? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: বন্দী শিবিরের অদ্ভুত জগতের প্রতি কয়েদিদের প্রতিক্রিয়া কি প্রমাণ করে যে মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের প্রভাব থেকে পালাতে পারেনা? এরকম পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের সাক্ষাতে মানুষের কি বিকল্প ক্রিয়া বা ক্রিয়া নির্বাচন করার সুযোগ থাকে না?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা অভিজ্ঞতার নিরিখে এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে দিতে পারি। শিবির জীবনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে বিকল্প ক্রিয়া বা পরিবেশের প্রতি আপনি কিভাবে আচরণ করবেন তা নির্বাচন করার সুযোগ মানুষের থাকে। শিবিরে তার বহু উদাহরণ ছিল যাতে প্রমাণ হয় যে উদাসীনতাকে অতিক্রম করা সম্ভব, সম্ভব বিরক্তি বোধকে দমন করা। যে উদাহরণ সমূহ অনেকটাই বীরত্বপূর্ণ প্রকৃতির। মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তির, মনের স্বাধীনতার, এমনকি এরকম মানসিক ও শারীরিক চাপের ভয়াবহ অবস্থার মাঝেও পদচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পারে।
আমরা বন্দী শিবিরে বাস করা আমাদের মতো যারা ছাউনির মধ্য দিয়ে হেটে হেটে অন্যদের সান্ত্বনা দিয়েছিল এমন লোকদের কথা স্মরণ করতে পারি। তারা অন্যের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল তাদের শেষ রুটিটিও। হতে পারে তারা সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রমাণ হয় যে, মানুষের কাছ থেকে সবকিছুই কেড়ে নেওয়া যেতে পারে, একটি জিনিস ব্যতীত: তা হলো প্রদত্ত কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের মধ্যে নিজের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিৎ তা নির্বাচন করার, কারো নিজের পথ বেছে নেওয়ার মানুষের স্বাধীনতা।
আর সেখানে সবসময়ই বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ ছিল। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। যেসব অপশক্তি আপনার একান্ত সত্ত্বাকে, আভ্যন্তরীণ মুক্তিকে আপনার কাছ থেকে হরণ করার হুমকি দেয় তার বাধ্য হবেন কি হবেন না তা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত। সে সিদ্ধান্ত কয়েদিদের সাধারণ গতানুগতিক ধারার রূপ ধারণ করতে স্বাধীনতা আর মর্যাদা পরিত্যাগ করে নিজেকে পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশের খেলনার বস্তু হবে কিনা তা নির্ধারণ করতো।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, নির্দিষ্ট শারীরিক ও সমাজতাত্ত্বিক অবস্থার নিছক অভিব্যক্তির চেয়ে বন্দী শিবিরের কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে আরও বেশি প্রতীয়মান হয়। যদিও ঘুমের অভাব, অপর্যাপ্ত খাবারের মতো অবস্থা এবং বহুবিধ মানসিক চাপ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কয়েদিরা নির্দিষ্ট কিছু উপায়ে প্রতিক্রিয়া করতে বাধ্য ছিল। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ফলে একজন কয়েদি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষে পরিণত হয়, কেবল মাত্র শিবিরের প্রভাবের ফলে নয়। মৌলিকভাবে, অতএব, এরকম পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশেও যে কোনো মানুষ মানসিকভাবে ও আধ্যাত্মিকভাবে তার পরিণতি কি হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি বন্দী শিবিরের মাঝেও সে ইচ্ছে করলে তার মানবিক মর্যাদা বজায় রাখতে পারে। রাশিয়ান উপন্যাসিক দার্শনিক ফয়ডর ডাফটাইয়েফস্কি একদা বলেছিলেন,“ আমি কেবলমাত্র একটি জিনিসকে ভয় করি: আমার যন্ত্রণার উপযুক্ত না হওয়া”। শিবিরে যাদের আচরণ, যাদের যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু কোনো পারিপার্শ্বিকতা বা পরিবেশে নিজের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিৎ তা নির্বাচন করার জন্য মানুষের আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা যে হারিয়ে যেতে পারে না সে সত্যের বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করা শহীদদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে একথাগুলি বার বার আমার মনে পড়তো। বলা যেতে পারে যে তারা তাদের যন্ত্রনাভোগের উপযুক্ত বা যোগ্য ছিল। যেভাবে তারা তাদের যন্ত্রণাকে সহ্য করেছিল তা ছিল এক অকৃত্রিম আভ্যন্তরীণ অর্জন। এই সেই আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা যাকে হরণ করা সম্ভব নয়, যা জীবনকে করে তুলো অর্থবহ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ।
সক্রিয় জীবন মানুষকে সৃজনশীল কর্মে তার মূল্যবোধকে অনুধাবনের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্য সরবরাহ করে, যেখানে উপভোগের নিষ্ক্রিয় জীবন সৌন্দর্য, শিল্প, বা প্রকৃতিকে উপভোগের মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা লাভের সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু অনেকটা সৃজনশীলতা আর উপভোগ বিবর্জিত জীবন ও যে জীবন এক উচ্চতর নৈতিক স্বভাবের সম্ভাবনাকে মেনে নেয় এমন জীবনেও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে। সেই উচ্চতর নৈতিক স্বভাব হতে পারে বাহ্যিক শক্তি দ্বারা সীমাবদ্ধ জীবনের প্রতি কোনো মানুষের মনোভাব। একটি সৃজনশীল জীবন ও একটি উপভোগের জীবন তার জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেবল সৃজনশীলতা আর উপভোগই অর্থবহ নয়। জীবনে যদি কোনো অর্থ থেকেই থাকে, তাহলে যন্ত্রণাভোগেও অবশ্যই কোনো অর্থ থাকতে হবে। যন্ত্রণা বা যন্ত্রণাভোগ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, নিয়তি আর মৃত্যুর ন্যায় মসৃণ। যন্ত্রণা আর মৃত্যু ছাড়া মানব জীবন অসম্পূর্ণ।
একজন মানুষ তার নিয়তি এবং এর সাথে অন্তর্ভুক্ত সকল যন্ত্রণাকে যেভাবে গ্রহণ করে, যেভাবে সে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও তার কষ্টভোগকে কাঁদে তুলে নেয়, তা তাকে তার জীবনে গভীর অর্থ সংযুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ করে দেয়। জীবন তখনও এক সাহসী, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বার্থহীন থাকতে পারে। নচেৎ আত্ম-সংরক্ষণের তিক্ত সংগ্রামে সে তার মানব মর্যাদা ভুলে গিয়ে একটি পশুর চেয়েও হীন কিছু হয়ে উঠতে পারে। কোনো কঠিন পরিস্থিতির দ্বারা সমর্থিত নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করবো, না বর্জন করব তাতেই একজন মানুষের সম্ভাবনা নিহিত। আর এটি সে যন্ত্রণাভোগের উপযুক্ত কিনা তার সিদ্ধান্ত দেয়।
মনে করবেন না যে এসব আলোচনা জগৎবহির্ভূত বা অপার্থিব আর বাস্তব জীবন থেকে অনেক দূরে। এটি সত্যি যে খুব কম মানুষই এরকম উচ্চতর নৈতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে সক্ষম। কয়েদিদের মাঝে কেবল কয়েকজন মানুষই তাদের পূর্ণ আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা ধরে রাখতে ও তাদের যন্ত্রণাভোগের দ্বারা আহুত মূল্যবোধকে অর্জন করতে পেরেছিল। কিন্তু মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তি যে তার বাহ্যিক পরিণতির/ভাগ্যের ঊর্ধ্বে উপনীত হতে পারে তার জন্য এরকম একটি উদাহরণই যথেষ্ট। এরকম মানুষ যে কেবলই শিবিরের মধ্যে রয়েছে তা নয়। যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে সর্বত্র মানুষকে তার পরিণতি বা ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হয়।
অসুস্থ মানুষদের পরিণতির কথা ধরুন—বিশেষ করে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের। আমি একসময় এক পঙ্গু ব্যক্তির লিখা একটি চিঠি পড়েছিলাম যাতে তিনি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন যে তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এমনকি কোনো অস্ত্রোপচারে তাতে কোনো লাভ হবে না। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, তিনি এক চলচ্চিত্রে দেখেছিলেন একজন মানুষকে সাহসী আর মর্যাদাপুর্ণভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে। ভালোভাবে মৃত্যুর সাক্ষাৎকে লোকটি এক বড় অর্জন বলে মনে করছিলেন তিনি। আর তিনি লিখেছিলেন যে নিয়তি তার জন্য এখন একই সুযোগ নিয়ে এসেছে। আমরা যারা কয়েক বছর আগে রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয়ের বই থেকে নেয়া Resurrection নামের চলচ্চিত্রটি দেখেছি তাদেরও হয়তো একই ভাবনা থাকতে পারে। তাতে আমরা মহান নিয়তি এবং মহান মানুষদের দেখতে পায়। আর সে সময় আমাদের জন্য ছিল না কোনো মহান নিয়তি বা ভাগ্য; ছিলনা এরকম মমত্ব অর্জনের সম্ভাবনাও। চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়ার পর আমরা পার্শ্ববর্তী এক ক্যাফেতে গিয়েছিলাম, কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে এক মুহূর্তের জন্য আমাদের মনে উদয় হওয়া অদ্ভুত আধ্যাত্মিক ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা নিজেরা যখন এক মহান নিয়তির মুখোমুখি হয় এবং উপযুক্ত আধ্যাত্মিক মহত্ত্ব নিয়ে তা মুকাবিলা করার সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়ে পড়ি, ততক্ষণে আমরা আমাদের অনেক আগের তারুণ্যপূর্ণ দৃঢ়তাকে ভুলে গিয়েছি, আর আমাদের জন্য ব্যর্থতা নেমে আসে অবধারিতভাবে।