স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: অর্থহীন জীবনের অর্থহীনতা ও আপনার স্বাস্থ্য অধিকার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: অর্থহীন জীবনের অর্থহীনতা ও আপনার স্বাস্থ্য অধিকার

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য এক বৃহৎ উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ-বিত্তরা অনায়াসেই দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলি ঠিকিয়ে রেখে প্রত্যাশিত স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করার সুযোগ থাকলেও দেশের খেটে খাওয়া মানুষ,যাদের দু’বেলার অন্য সংস্থান করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় বা যাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করার জন্য সঞ্চিত অর্থ নেই বেঁচে থাকার অধিকার বা বেঁচে থাকার বা স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার প্রত্যাশা বরাবরই অনধিকার চর্চার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রবল অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও  সাধারণ মানুষগুলি হয় দুর্নীতি না হয় অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়ের ভারে ধরাশায়ী।

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় ও অর্থহীন মানুষেরা

অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় যে কত করুনতম হতে পারে তার কয়েকটি চিত্র লক্ষ্য করি।  সত্য ঘটনা অলম্বনে বলিউডের তৈরি ২০১৫ এর Manjhi: The Mountain man চলিচ্চিত্রটি অসুস্থ মানুষের দ্বারা চিকি‌ৎসা সেবায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বিপত্তির একটি নমুনা।  ছবির নায়ক দশরথ মাঝি, যিনি ‘পর্বত মানব’ হিসেবে পরিচিত ভারতের বিহার রাজ্যের গেহলর অঞ্চলের পাথুরে পর্বত কাটতে শুরু করেন।  তিনি কেবল একখানা মাস্তুল আর একখানা বাটালি ব্যবহার করে ২৫ ফুট উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ৩০ ফুট প্রশস্ত, ৩৬০ ফুট লম্বা পথ তৈরি করতে সমর্থ হন। 

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় ও মাঝি: দ্য মাউন্টেন ম্যান -২০১৫
স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় ও মাঝি:
দ্য মাউন্টেন ম্যান -২০১৫

তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পাহাড় কেটে পথ বানানোর সংকল্প করেন যাতে নিকটস্থ শহর ওয়াজিরগঞ্জে যারা চিকিত্সা সেবার জন্য যাতায়াত করেন তাদের কষ্ট না হয়।  তাঁর অক্লান্ত সংকল্প আর সহিঞ্ঝুতাকে কাজে লাগিয়ে এবং ২২বছর পর তিনি সফলভাবে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন।  সেখানে এখন একটি পথ আছে যেটি ব্যবহার করে লোকজন সাস্থ্য-সেবা নিতে যায়।  দশরথ মাঝি ২০০৭ সালে মারা যান।

দশরথ মাঝির মৃত্যুর ১১ বছর পর অন্য একজন মাঝি ওরিষার ভাওয়ানিপান্থ শহর হাসপাতাল থেকে ৬৯ মাইল দুরে অবস্থিত তার গ্রামে তাঁর মৃত স্ত্রীর লাশ কাঁধে বহন করে নিয়ে যান।  নিঃস্ব, হাসপাতাল হতে এম্বুলেন্স না পেয়ে আর কোন বাহন ভাড়া করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি তাঁর ১২ বছরের মেয়েকে সঙ্গী করে মৃত দেহটি কাঁধে বহন করে নিয়ে যেতে বাধ্য হন।  যদিও ১২ মাইল হাঁটার পর তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে সহায়তা পান।

বিশাল অংকের মেডিকেল বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে একজন দিন মজুর এবং তাঁর স্ত্রী তাদের সদ্যোজাত নবজাতককে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান।  ঘটনাটি ঘটে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, দেশের কুমিল্লা জেলায়। 

মৃত ব্যক্তির পরিবার ৩১,০০০,০০ টাকা হাসপাতাল বিলের ১২,০০০,০০ টাকা পরিশোধ করতে সমর্থ হলেও কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ না করা পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির লাশ ছাড়তে রাজি হয়নি।  রাজধানীতে হাসপাতালের ICU তে বাচ্চার মৃত দেহ রেখে মৃতের পরিবারের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। 

রানা প্লাজা ধ্বসের পর জীবিতদের নিকট চিকিত্সা সেবা নিয়ে এগিয়ে আসা এনাম মেডিকেল কলেজ গার্মেন্টস কর্মীদের আটকে রেখেছে  আরেক খবরে প্রকাশ হয় যে তাগড়া অর্থ ১২০,০০০,০০ টাকার চিকিত্সা বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সদ্যোজাত বাচ্চাসহ বাচ্চার মা-বাবাকে মাস মাস ধরে হাসপাতাল কক্ষে আটকে রাখছে।  জমি বিক্রি আর ঋন করে নিয়ে আসা ৭,০০০ টাকায় কোন কাজ হয়নি।

লালমনিরহাট জেলায় চিকিৎসার অভাবে মারা যান এক ব্যবসায়ী যুবক।  কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের আব্বাস আলী দুই-দুইটি হাসপাতাল ঘুরে এসেও চিকিত্সা পাননি।  অস্ত্রোপচারের অর্থ ব্যয়ে অসমর্থ হলে হাসপাতাল তাঁকে বিনা চিকিত্সায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।  আরেক পৃথক ঘটনায় নীলফামারির ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা না পেয়ে বিগত বছরে মারা গেছে একসাথে দুজন রোগী।  মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা দাবি করে যে যখন তাদের ভর্তি করা হয় তখন কর্তব্যরত কোন ডাক্তার সেখানে ছিলনা। 

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: অর্থের অভাবের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এম্বুলেন্স দেয়নি বলে দশরথ তার মৃত স্ত্রীর লাশ কাঁধে বহন করে বাড়ি যাচ্ছেন। ছবি: বিবিসি নিউজ

জন্ম পরবর্তী চিকিত্সার অভাবে মারা যায় এক নবজাতক শিশু।  হাসপাতালে ভর্তি করাতে ঘুষ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আরেক রোগী মারা যান।  এগুলো কেবল প্রকাশ পাওয়া খবরের কয়েকটি। এরকম অনেক খবর রয়ে যায় দৃষ্টির বাইরে, অপ্রকাশিত আর অনুন্নত এবং সল্পোন্নত এলাকায় ঘটে বলে ঢেকে রাখা হয় অনেক খবর।

কর্তব্যরত চিকিত্সকের অবহেলায় শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।  অভিযোগ উঠে যে শিশুটিকে ভর্তি হওয়ার পরও চিকিত্সক Facebook এ ব্যস্থ ছিলেন। 

২১ শতাদ্বির এই দিনে মানুষকে আজ আর দশরথ মাঝির মতো পাথুরে পাহাড় টপকাতে হয়না, সড়ক নির্মিত হয়েছে, যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে দারিদ্রতা ৩০% হ্রাস পেয়েছে পৃথিবীতে, ২০৩০ সালে পৃথিবী হবে দারিদ্র মুক্ত, সচেতনতা আর শিক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে, কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের স্বাস্থ্য অধিকারের প্রশ্ন এখনও একটি দুর্লব বস্তু, বিশেষ করে বাংলাদেশে।

আপনার স্বাস্থ্য অধিকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে সার্বজনিন স্বাস্থ্য সেবা বা (UHC) হলো “প্রাথমিক অগ্রগতিমুলক, প্রতিকারমূলক, প্রতিরুধমূলক এবং পূনর্বাসনমূলক সাধ্যের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশ, যাতে সবার সমান প্রবেশাধিকার অর্জন করা যায়।  সার্বজনিন স্বাস্থ্য সেবার দিকে অগ্রসর হতে সকল দেশ উন্নয়নের সকল পর্যায়ে, তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে পারে।

স্বাস্থ্যকে বিশ্ব-ব্যাপী মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে ধরা হয়।  অসুস্থ স্বাস্থ্য দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতার কারণ আর পরিনতি কিনা; অথবা দারিদ্রতা অসুস্থ স্বাস্থ্য, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতার কারণ আর পরিনতি কিনা তা হয়তো বিতর্কের বিষয়।  মানব উন্নয়নমূলক পলিচি নির্ধারণ কেবল কোন দেশের জনগনের অর্থনৈতিক আয় বৃদ্ধি করে না বরং জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের অন্যান্য উপাদান যেমন আয়ু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্ঞান এবং ভাগ্য নির্ধারনেও উন্নয় ঘটে।

স্বাস্থ্য হলো মানব উন্নয়নের প্রধান উপায় এবং তার চুড়ান্ত ফলাফল।  উন্নততর স্বাস্থ্য একটি প্রধান লক্ষ্য যা মানুষের সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা আর শারীরিক সামর্থকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশে অবস্থান আর সেবার ক্ষেত্রে দারিদ্রতা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বাঁধা এবং দারিদ্রতা আর প্রজননগত নির্ণয়ের মাঝে স্বাস্থ্য একটি কঠিন মধ্যস্ততাকারী। 

গুজরাটের Environmental Planning and Technology University এর গবেষক লিখেন যে, “স্বাস্থ্যের তিনটি আলাদা গুরুত্ব আছে: (ক) স্বভাবজাত গুরুত্ব, (খ) ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পর্যায়ে উপায়ভূত গুরুত্ব এবং (গ) ক্ষমতায়নে গুরুত্ব।  স্বভাবজাতগতভাবে স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি মানব কল্যানের দ্বার্থহীন মানদন্ড।  এটি জীবনের পূর্ণতা এবং একটি অমূল্য অর্জন।  যেমন, সু-স্বাস্থ্যের কাছে অর্থনৈতিক যুক্তি বিদ্যমান।  উন্নত স্বাস্থ্য সরকার আর পরিবার উভয়রেই হাসপাতাল ব্যয় কমায়।  শিশুদের ক্ষেত্রে উন্নত স্বাস্থ্য শিক্ষাঙ্গনে শিশুদের অপেক্ষাকৃত ভাল উপস্থিতি আর অপেক্ষাকৃত উন্নত পর্যায়ের জ্ঞান অর্জনের দিকে পরিচালিত করে।  অপেক্ষাকৃত ভাল শিক্ষা এবং জ্ঞান অপেক্ষাকৃত ভাল চাকরি আর ভবিষ্যত প্রজন্মকে বৃহত্তর সুবিধা দিকে ধাবিত করে।  মহিলাদের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ভাল স্বাস্থ্যের অবস্থান অর্জন হয়।  আর এটি মহিলাদেরকে অর্থনৈতিক আর গণ-জীবনে অংশ গ্রহণ করতে শক্তিশালী করে তুলে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে যে স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ প্রাপ্য মর্যাদার আনন্দ হলো মৌলিক মানবাধিকার।  স্বাস্থ্য অধিকার একটি সর্বব্যাপী অধিকার।  স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের দিকে ধাবিদ করতে পারে এমন বিস্তৃর্ণ বিষয়াধি স্বাস্থ্য অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।  আন্তের্জাতিকভাবে ১৯৪৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানে এটি প্রথমবারের মতো সংযোজন করা হয়, যার প্রস্তাবনার বর্ণনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিকার মানে “কেবল অসুস্থতা বা বৈকল্য থেকে মুক্তি মানেই সু-স্বাস্থ্য নয়, এটি শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুখ ও সমৃদ্ধির পরিপূর্ণ অবস্থা”।  আরো বলে যে, স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ প্রাপ্য মর্জাদার আনন্দ হলো বর্ণ, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অস্থা নির্বিশেষে সকল অবস্থার মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি স্বাস্থ্যের ভিত্তি নির্ধারক”।  WHO এর মতে:

১. স্বাস্থ্য অধিকার সম্মতিহীন মেডিকেল চিকিত্সা যেমন মেডিকেল নিরিক্ষণ এবং গবেষণা অথবা জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ এবং নির্যাতন আর বর্বর, অমানবিক অথবা অপমানকর চিকিত্সা বা শাস্তি থেকে মুক্ত থাকার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

২. স্বাস্থ্য অধিকারে রয়েছে কিছু অধিকার যা সংযুক্ত করে:

(ক) যে প্রক্রিয়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরবরাহ করে সবার জন্য স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ প্রাপ্য পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা উপভোগ করতে সুযোগের সমতা বিধান করে তার প্রতি অধিকার;

(খ) রোগের নিবারণ, চিকিত্সা এবং নিয়ন্ত্রনের প্রতি অধিকার;

(গ) প্রয়োজনীয় ঔষধ-পত্র পাওয়া;

(ঘ) মাতৃত্ব, শিশু এবং প্রজনন স্বাস্থ্য;

(ঙ) মৌলিক স্বাস্থ্য সেবায় সম এবং সময়োচিত প্রবেশাধিকার ;

(চ) স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষা এবং তথ্যের ব্যবস্থা;

(ছ) জাতীয় এবং সামাজিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহনে জনগনের অংশ গ্রহণ ।

৩. স্বাস্থ্য সেবা, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র এবং সুবিধাদি কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়া সরবরাহ করতে হবে।  বৈষম্যহীনতা মানবাধিকারের মৌলনীতি আর স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ প্রাপ্য পর্যায়ের উপভোগ করার জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. সকল স্বাস্থ্য সেবা, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র এবং সুবিধাদি অবশ্যই হতে হবে সহজ-লভ্য, উপযোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং গুনাগুন সম্পন্ন।  

৫. সচল জন-স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য সেবামূলক সুবিধাদি, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ও অন্যান্য সেবা সমূহ অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমানে রাষ্ট্রে বিদ্যমান থাকা চাই।

৬. আর তাতে থাকতে হবে বৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে শারিরীক, অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার ( সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে, শিশু, কিশোর, বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য অরক্ষিত দল)।  গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য চাওয়া, পাওয়া এবং আদান-প্রদানের অধিকারও স্বাস্থ্য সেবা প্রবেশাধিকার নির্দেশ করে (প্রতিবন্ধী সহ সবার জন্য), কিন্তু তার মানে এই নয় যে গোপনীয় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সেবার তথ্য থেকে কাউকে বঞ্চিত করা হবে।

৭. স্বাস্থ্য সেবামূলক সুবিধাদি, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র চিকিত্সা-নীতি অনুসারে হতে হবে, এবং লিঙ্গ সংবেধনশীল এবং সাংস্কৃতিকভাবে যথাযথ।  অন্য অর্থে, তা হতে হবে চিকিত্সা-নীতি অনুযায়ী এবং কৃষ্টিগতভাবে গ্রহণযোগ্য।

৮. সর্বোপরি, স্বাস্থ্য সেবামূলক সুবিধাদি, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র অবশ্যই হতে হবে বৈজ্ঞানিক আর চিকিত্সাশাস্ত্রগতভাবে যথাযথ এবং ভালো মানের।  তাতে বিশেষভাবে স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের হতে হবে প্রশিক্ষিত, বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্বীকৃত এবং মেয়াদোত্তীর্নহীন ঔষাধাদি এবং হাসপাতাল যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং নিরাপদ খাবার পানীয়। 

মানুষের স্বাস্থ্য সেবা অধিকার সবার অধিকার।  এই অধিকার সবার।   যাদের পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বীমা এবং স্বাস্থ্য সেবার সামর্থ নাই তাদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে।  বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সবার অধিকার।  স্বস্থ্য অধিকার হলো নুন্যতম স্বাস্থ্যের নিরিখে সার্বজনিন, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার যাতে সকল মানুষের অধিকার রয়েছে।  এই সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে অগ্রগতির পথে বাঁধা প্রচুর।  

অগ্রগতির পথে বাঁধা সমূহ

স্বাধীনতার পর থেকে যদিও বাংলাদেশ সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে, বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য।  গ্রাম অঞ্চলে ও শহরাঞ্চলের বস্তিতে বসবাসরত দরিদ্র শ্রেণীর হাজার হাজার মহিলা ও শিশুদের কাছে নাই কোন স্বাস্থ্য সেবার জিনিস-পত্র অথবা তাদের অসুস্থতার প্রবলতা প্রশমিত করার মতো স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশাধিকার।  গুনগত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া, কারো উপার্জন ক্ষমতা না হারিয়ে দ্রুত রোগমুক্তি, স্বাস্থ্য সেবার জন্য গলাকাটা মূল্য পরিশোধ অসুস্থতারই ন্যায় অনিশ্চি হয়ে পড়েছে।

তাই, দেশের চলমান স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা, “ঔষধ পত্র এবং প্রয়োজনীয় পন্যের অপর্যাপ্ততা , গরিবদের প্রতি বৈষম্য, অনুমোদনহীন ফি আরোপ, দক্ষ স্বাস্থ্য সেবাদানকারী অভাব, দুর্বল রেফারেল কার্যক্রম, প্রতিকূল খোলার ঘন্টা এবং আন্তর্বিভাগীয় সমস্যা বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য সুবিধার কম ব্যবহারের জন্য দায়ী।  চলমান পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের শহর আর গ্রামের মাঝে অসম বন্টন, যেখানে মফস্যলের সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো শুন্য থাকে যা দেশের স্বাস্থ খাতকে দুর্দশাগ্রস্থ করে। দরিদ্র আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রোগীদেরকে এর ভার শইতে হয়।

Transparency International Bangladesh এর অনুসন্ধান অনুযায়ী ‘দেশের হাসপাতাল এবং রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলো অতিরিক্ত মুনাফা লোভী ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, কমিশন ভিত্তিক মার্কেট পদ্ধতি যেখানে ডাক্তার থেকে শুরু করে রিসিপশনিষ্ট পর্যন্ত সবাই এই বিস্তৃত অপকর্ম থেকে মুনাফা গ্রহণ করে। 

স্বাস্থ্য সেবায় উঁচু মাত্রায় খরচ বহন করতে অসমর্থ বলে দেশের ১৫% মানুষ চিকিৎসা পায়নি।  ফলশ্রুতিতে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদেরকেই স্বাস্থ্য সেবার এই বোঝা বয়তে হয় প্রতিনিয়ত।

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: অতিরিক্ত খরচের কারণে বাংলাদেশের ১৫% মানুষ চিকিৎসা সেবা পায়নি।
স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: অতিরিক্ত খরচের কারণে বাংলাদেশের ১৫% মানুষ চিকিৎসা সেবা পায়নি।

দেশের স্বাস্থ্য সেবা খরচকে সরাসরি চিকিৎসা খরচ (যেমন ঔষধ এবং অন্যান্য সেবামূলক খরচ), সরাসরি নন-চিকিৎসা খরচ ( পরিবহন খরচ ইত্যাদি) এবং পরোক্ষ খরচে (যেমন ভ্রমণ, অপেক্ষা করা, উপার্জনের ক্ষতি ইত্যাদি) বিভক্ত করা যায় ।  প্রাপ্ত নমুনাতে দেখা যায় যে ঔষধ সম্পর্কিত ব্যয় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত করে। 

পরোক্ষ খরচ হলো অসুস্থতার দরুণ রোগী এবং পরিবারের সদস্যদের উৎপাদনশীল সময়ের অর্থনৈতিক মূল্যের অপচয়।  গবেষণা মতে, অসুস্থতার পরোক্ষ চিকিৎসা ব্যয়; যেমন ঔষধ খরচ, বক্ষব্যধীর ঔষধ, অর্থোপেডিক্স, বাতরোগ সংক্রান্ত বিভাগ ব্যতিত প্রাইভেট হাসপাতালের রোগীদের তুলনায় সরকারি হাসপাতালেও বেশী ছিল।  প্রত্যক্ষ খরচের মধ্যে চিকিৎসা এবং নন-চিকিৎসা খরচের অন্তর্ভুক্ত; রোগ নির্নয়, নিবন্ধন ফি, ঔষধ, চলমান সেবা, হাসপাতালে ভর্তি খরচ, পুনর্বাসন চিকিত্সা খরচে অন্তর্ভুক্ত; হাসপাতালে যাতায়াত খরচ এবং নন-অফিসিয়াল খরচ সমূহ নন-চিকিৎসা খরচে অন্তর্ভুক্ত।  দ্রুত আর উন্নত চিকিৎসার প্রত্যাশায় রোগীর কাছ থেকে হাসপাতাল স্টাফদের নিকট অর্থনৈতিক লেনদেন সমূহ অনানুষ্ঠানিক খরচ।  অসুস্থতা চিকিৎসার প্রত্যক্ষ খরচ সার্জারী, গাইনি এবং অর্থোপেডিক ব্যতীত সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের সব বিভাগেই বেশি। 

একইভাবে, প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, স্বাস্থ্য খাতে দুর্বল শাসনকার্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করছে, যা স্বাস্থ্য সেবার পরিবর্তে সরকারি সুবিধার ব্যবহার কম হচ্ছে।   

বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় সরকারি হাসপাতালের রোগীদের অত্যধিক পরোক্ষ খরচ প্রাথমিকভাবে বেশী পরিমানে ভ্রমন এবং অপেক্ষা সময়ের মাধ্যমে বোঝা যায়।  সরকারি হাসপাতালের রোগীরা সেবা পেতে গড়ে দ্বিগুন সময় স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করে, যা হাসপাতালে আসতে দীর্ঘ যাত্রা সময় এবং চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করার সাথে সম্পৃক্ত।  সরকারি হাসপাতালের রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালের রোগীর তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুন সময় ব্যয় করে।  বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালের রোগীরা (৭১%) মফস্যল এলাকা থেকে আসে এবং  তাদের ভ্রমন সময় আর খরচ বিশেষ করে শহরে বাস করা রোগী যারা হাসপাতালে আসে তুলনায় বেশি। 

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা অপর্যাপ্ত রয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য সব সময় লম্বা লাইন পরিলক্ষিত হয়েছে।  সরকারি হাসপাতালের কিছু রোগীকে চিকিত্সকের সাথে তাড়াতাড়ি সাক্ষাত করার জন্য স্টাফদের ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে লাইনে আগে চলে যেতে দেখা গেছে।  গবেষণার ১৩৯ সাবজেক্টের মাঝে ১১৪ জন (৮২%) রোগী দ্রুত ডাক্তারের সাথে সাক্ষাত করার জন্য অনানুষ্ঠানিক অর্থের লেনদেন করেছে।  অন্য দিকে, ১১৩ জন রোগীর মাঝে ৪৪ জন (৩৮%)  বেসরকারি হাসপাতালের রোগী দ্রুত ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনানুষ্ঠানিক অর্থের লেনদেন করেছে। 

দক্ষ এবং কার্যকর কর্ম পরিবেশের অভাবে সরকারি হাসপাতালের সেবার গুনগতমান বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় নিম্ন মানের।  অনানুষ্ঠানিক লেনদেন, দীর্ঘ অপেক্ষার লাইন এবং কর্মচারীদের অমনোযোগিতা আর অবহেলায় তা প্রতিয়মান হয়। 

 দরিদ্র লোকজন কেন সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ব্যবহার করে তার পেছনে কিছু কারণ আছে।  প্রথমতঃ, যথযথ খাদ্যাভ্যাসের অভাব আর অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের কারণে দরিদ্র মানুষের অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি।  দ্বিতীয়তঃ স্বল্প মানের শিক্ষা আর আয়, আর উচ্চ মাত্রার পুষ্টিহীনতা, এবং কম পুষ্টি দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের জন্য উচ্চ মাত্রার বিকারগ্রস্ততার কারণ হতে পারে, কিন্তু তাতে করে সরকারি সুবিধার উচ্চতর ব্যবহারও হয়ে থাকে।  তৃতীয়তঃ অসুস্থ হলে তুলনামূলভাবে সস্তা হওয়ায় গরীব মানুষের সরকারি হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা যখন ধনী রোগীরা বেছে নিতে সক্ষম হয় অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন চিকিৎসক বা বেসরকারি সুবিধা যেখানে সময়ের অপচয় কম হয়।  ধনীদের দ্বারা তুলনামুলক উন্নত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার এই সংস্কৃতি তাদেরকে পক্ষপাতিত্যমূলক চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ করে দেয় যেন এই বৈষম্যমূলক চিকিৎসা সেবার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত।

গবেষণাধীন রোগীদের মতামত অনুযায়ী, সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় মাত্র ২৩.৯ % বহির্বিভাগীয় রোগী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ঔষধ পেয়েছে, অনুরুপভাবে অভ্যন্তরীণ রোগীদের নমুনা আরো ছোট, মাত্র ৭%।  একইভাবে, আরেক গবেষণায় লক্ষ্য করা যায় প্রায় ৩/৫ অংশ অভ্যন্তরীণ রোগী (৬২%) এবং ৪৮.৩% বহির্বিভাগীয় রোগী ৫০% এর কম তাদের প্রয়োজনীয় ঔষধ পেয়েছে সরকারি হাসপাতাল থেকে।  আবার, ১৪% বহির্বিভাগীয় এবং ৮% অভ্যন্তরীণ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে কোন ঔষধই পাননি।  ইনজেকশন আর আইভি ফ্লুয়িডের ক্ষেত্র পরিস্থতি আরো মন্দ।  অর্ধেকেরও অধিক অভ্যন্তরীণ রোগী (৫৪%) কোন ধরনের ইন্জেক্ট্যাবল এবং ৬৬% আইভি/স্যালাইন পাননি হাসপাতাল থেকে। 

বহির্বিভাগীয় এবং অভ্যন্তরীণ রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা প্রায় সময় আগাম চিকিৎসা খরচের জন্ম দেয়।  ঔষধ খরচ, পরীক্ষা আর রোগ নির্ণয় সম্পর্কিত বিভিন্ন খরচ এবং হাসপাতালে ভর্তি ব্যয় যা সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা।  চরম পর্যায়ের দরিদ্র সংসার আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও অধিক স্বাস্থ্য সেবার পেছনের ব্যয় করে থাকে। 

আপনার স্বাস্থ্যের ব্যয় কত?

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে পৃথিবীতে ১০% মানুষের দৈনিক আয় এখনো ১.৯০ মার্কিন ডলার যেখানে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ যারা দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে তারা তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত।  প্রায় ৬% মানুষের এখনো যথাযথ স্বাস্থ্য সেবার অভাব রয়েছে।

প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য সেবার অন্তরায় হচ্ছে দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যক্তিগত ব্যয়ে (out-of-pocket expenditure or OOP) বাধ্য যা তাদেরকে আরো দরিদ্রতার দিকে ধাবিত করে।  একজন মানুষের পারিবারিক গড় আয়ের তুলনায় বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় অনেক ব্যয় বহুল, যা অনেক সময় কষ্টকর এবং সর্বনাশা এই স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রভাব পরিবারকে অসহায় করে ছাড়ে। Bangladesh National Health Account অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় (OOP) ৬৭% যা গ্লোবাল গড় ৩২% এর চেয়ে বেশী।

“OOP পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশদাতা হলো সরকার।  বাকীটুকু আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আর উন্নয়নের অংশীদার যেমন বেসরকারি সংস্থা (NGOs) থেকে আসে যা ১% -২% পর্যন্ত।  অধিকন্তু, GDP (Gross Domestic Product) হারে পারিবারিক ব্যয় ২০১০ সালে ১.৬% থেকে ২০% পর্যন্ত বেড়েছে”। প্রতি বছর প্রায় ৬.৪ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ৪% মানুষ অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হয় যায়।  মোট জনসংখ্যার দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা ২০% মানুষ তাদের পারিবারিক আয়ের ১৬.৫% অর্থ প্রত্যক্ষ চিকিৎসা খরচে ব্যয় করে, যেখানে ধনী শ্রেণীর ২০% ব্যয় করে কেবল ৯.২% অর্থ।

অতিরিক্ত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়ের (OOP) দরুণ যে ‘স্বাস্থ্য-দুর্দশা’ হয় তা হতে পারে লোকজনের জন্য সর্বনাশা, যা অসহায় পরিবারকে অনির্দিষ্টভাবে দরিদ্রতার চক্রেও আটকে রাখতে পারে।  লোকনীতির দৃষ্টিতে এটি একটি বড় উদ্বেগ।  

বাংলাদেশের ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয়।
বাংলাদেশের ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয়।

একটি স্টাডির মতে, “ প্রায় ৪০% পরিবার অসুস্থতার দরুণ এক বছরে কর্ম দিবসের ক্ষতি হয়েছে বলে জানায়।  সঞ্চয় বা মূলধনের অপচয় উন্নয়নশীল দেশের অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতি মিলে তাদের টিকে থাকার সীমিত সামর্থ্যের কারণে দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্রতার দিকে ধাবিত হচ্ছে (আর নিম্ন-আয়ের দারিদ্রতাহীনদের দরিদ্রতার মাঝে)।  গবেষণার আওতাধীন ৩,৯৪১ পরিবার (১৯,৪২৪ জন ব্যক্তির অংশগগ্রহণে)  বর্ননায় ১,৪৫৭ জন ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে পূর্ববর্তী ১২ মাসে কাজ করতে পারেনি।  এই দলটির ৪৬২ জন ব্যক্তি ৫ সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজ হারিয়েছে, যেখানে ২১৯ জন ব্যক্তি ৩১ দিনের বেশী ধরে দৈনিক কাজ থেকে বিরত থেকেছে। 

সবমিলিয়ে, দুই বছরে মোট ১,১৮৬টি ঘটনাকে ‘স্বাস্থ্য-দুর্দশা’ হিসেবে শ্রেনী-বিন্যাস করা যেতে পারে, যেখানে ‘দুর্দশা’ অসুস্থতা সম্পর্কিত ব্যয় অথবা অসুস্থতার স্থিতিকালের বেলায় একটি সুনির্দিষ্ট সুচনাকে সংযুক্তির সাথে সজ্ঞায়িত।  গরীব আর শিশুরাই হলো সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রেণী। 

গবেষণায় দেখা যায় যে, “স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় (OOP) উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে।  অসুস্থতার আকস্মিক গুরুতর বৈশিষ্ট্য গরীবের সংকটময় সংবেদনশীলতাকে অপ্রত্যাশিত, স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত অপরিকল্পিত অসহায়তা, উপার্জন হারানোর দরুণ ঋনগ্রস্থতা, এবং বেকারত্বে রুপান্তর করে।  ফার্মাসিউটিক্যাল ক্রয়ে অত্যধিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় (OOP) বাংলাদেশে সবচেয়ে স্বাতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য।  স্বাস্থ্য সেবার ৬৫% ব্যয় হয় ঔষধ ক্রয় আর চিকিৎসা পরামর্শে”।  ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়ের (OOP) অন্য উপদান সমূহ হলো নিরাময়কারী সেবা (২২.০০%), আনুষঙ্গিক সেবা (৯.০%), বহির্বিভাগীয় এবং বাড়ি-ভিত্তিক সেবা (৪%) এবং সাধারণ সরকারি স্বাস্থ্য প্রশাসন ১.% এর কম।

স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় (OOP) উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়বহুল কারণ বাংলাদেশের ২৫.৫% জনসংখ্যা এখনো দরিদ্র সীমার নীচে। ১২,২৪০টি পরিবারকে কেন্দ্র করে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, “অত্যধিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়ের ফলাফল খুব (OOP) অস্বাভাবিক।  কোন কোন পরিবার অত্যধিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্য সেবা কাজে লাগাতে পারছেনা, যা তাদেরকে আংশিক স্বাস্থ্য সেবা নিতে বাধ্য করছে আর তা ব্যধি পরিস্থিতিকে আরো যন্ত্রনাদায়ক করে তুলে যার দরুণ অসুস্থতা দুরারোগ্য পরিস্থতিতে রুপান্তরিত হয়। 

চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে পরিবার অস্থাবর এবং স্থাবর সম্পদ বিক্রয় করতে পারে যা তাদেরকে আরো দরিদ্র করে তুলে।  অত্যধিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়ের (OOP) কারণে পরিবারকে খাদ্য বস্তুর পরিমান নির্ধারন করতে হয় যা তাদের পুষ্টিহীন করে তুলতে পারে।  ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় শিশুদের জন্য স্কুল থেকে ঝরে পড়ার কারণ হয়ে তাদের শিক্ষায় প্রভাব পেলতে পারে। 

দরিদ্র শ্রেণীর জনগনকে বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মেটাতে হয়, যা সঞ্চয় উত্তোলন, বন্ধু/বান্ধব/মহাজনের কাছ থেকে ঋন গ্রহণ, গৃহস্থ্লী জিনিসপত্র বা সম্পদের পীড়াদায়ক বিক্রিতে অন্তর্ভুক্ত।  সম্পূর্ণ ঔষধ ক্রয়ের জন্য তাও পর্যাপ্ত না হতে পারে।  গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে স্বাস্থ্য ব্যয় অন্যের জীবিকার উত্স বিলম্বিত করে ( সংকুচিত খাদ্য গ্রহণ, শিক্ষায় কম খরচ ইত্যাদি)।  সর্বোপরি, ১৮.৬% পরিবার তাদের সন্তানের ব্যয় মিটাতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।  তাই, চিকিৎসা এবং হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন এমন অসুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপর প্রতিকূল প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।  সঞ্চয় থেকে টাকা উত্তোলন, বন্ধু/বান্ধব/মহাজনের কাছ থেকে ঋন গ্রহণ, গৃহস্থ্লী জিনিসপত্র বা সম্পদের পীড়াদায়ক বিক্রি হতে পারে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশের জন্য একমাত্র উপায়। 

প্রাথমিকভাবে এই ফলাফলের কারণ অস্বচ্ছল শ্রেণীর মানুষেরা তাদের আয়ের অধিকাংশ খাবার এবং দৈনিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ে ব্যয় করে থাকে এতে করে খুব কমই স্বাস্থ্য সেবাতে ব্যয়ের জন্য অবশিষ্ট্য থাকে।  অনুসন্ধান পরিস্কার বলে দেয় যে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের প্রাপ্য স্বাস্থ্য সেবার উৎসে প্রবেশ কম এবং চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে তাদের প্রচুর অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।  অনুন্ধান আরো নির্দেশ করে যে, নিম্ন আয়ের পরিবারবর্গের জন্য “অনিষ্টকর ব্যয়” ঘটিত ঋনগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে”।  Public Health Foundation of India এর গবেষণা অনুযায়ী মোট পারিবারিক ব্যয়ের ১০% এর অধিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয়কে (OOP) “অনিষ্টকর ব্যয়” হিসেবে সজ্ঞায়িত। 

“স্বাস্থ্য বাজেট” এর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ১৫% তো দূরের কথা বাংলাদেশ সরকার মোট বাজেটের মাত্র ৫% স্বাস্থ্য সেবায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ করেছে যা পূর্ববর্তী অর্থ বছরের চেয়ে কম (৫.৩৯%)।  এই অযাচিত এবং অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য বাজেট গরীবের উপর চাপ বৃদ্ধি করছে।  

২০১৭ তে স্বাস্থ্য খাতে OECD (The Organisation for Economic Co-operation and Developement) দেশগুলোর মোট GDP র গড় ব্যয় ছিল ৬% যাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বাজেট ছিল সর্বোচ্চ, ১৭.২%। 

রিপোর্টে দেখা যায় যে স্বাস্থ্য সেবা ক্রয়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ৭৫% ক্যান্সার রোগীকে “অনিষ্টকর ব্যয়” এর মুখোমুখি অথবা নির্নয়ের এক বছরের মধ্যে মৃত্যু বরণ করতে হয়।

চিকিৎসা সেবার অনুভুত প্রয়োজন নির্ভর করবে স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা সমূহের সহজলভ্যতা এবং তার জন্য ব্যয় করার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর । 

অস্ত্রোপচারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি বা দীর্ঘদিন হাসপাতালে অবস্থান শারীরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পরিবারকে ধ্বংস করে।  তাদেরকে যেমন চিকিৎসায় খরচ করতে হয় একই সময় তাদের উপার্জনের ক্ষতি হয়- অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাস।  শারীরিক আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে উঠে অপূরণীয় যদি রোগী হয়ে থাকে পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারী।

দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সেবা ব্যয় নেতিবাচকভাবে পরিবারের জন্য অপ্রতুল খাদ্যের সরবরাহের কারণ হয়ে উঠে, বিলম্বিত স্কুল ফি প্রদান শিশুদের শিক্ষায় প্রভাব ফেলে এবং শিশুরা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বস্তু থেকে বঞ্চিত হয়।  যে পরিবার সমূহ ইতিমধ্যে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়ে আক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে খাদ্য গ্রহণ ৫৭% কমিয়ে আনতে হয়, অনুসন্ধানের ৭৯.২% ঘটনায় দেখা যায় সংসারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বস্তুর খরচ সংকুচিত করতে হয়েছে চিকিৎসা খরচের কারণে। 

স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরদের তাদের আয়ের ১ তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করতে হয়।
স্বাস্থ্য সেবা ব্যয়: দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরদের তাদের আয়ের ১ তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করতে হয়।

দেশের স্বাস্থ্য পদ্ধতি ক্রমাধিকারতন্ত্রভাবে কাটামোবদ্ধ এবং একটি পাঁচ স্তর বিশিষ্ট পিরামিডের সাথে তুলনা করা যায়।  প্রথমতঃ পিরামিডের মৌলে রয়েছে ওয়ার্ড পর্যায়ের চিকিৎসা সুবিধা (কমিউনিটি ক্লিনিক), যেখানে রয়েছে একজন স্বাস্থ্য এবং একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী।  তারপর দ্বিতীয় স্তরে একজন মেডিকেল সহকারী এবং পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক, একজন ফার্মাসিস্ট যিনি মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্য ব্যস্থায় মনোনিবেশ করেন এবং সীমিত আকারে নিরাময়মূলক সেবা প্রদান করেন- এসব  নিয়ে রয়েছে (HFWC) ইউনিয়ন স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।  পিরামিডের তৃতীয় স্তরে রয়েছে (UHC) উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র। 

UHC তে রয়েছে নয়জন চিকিৎসক, দুজন মেডিকেল সহকারী, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন রেডিওগ্রাফার এবং EPI একজন কারিগর।  অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিভাগভীয় স্বাস্থ্য সেবা, মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্য সেবা এবং রোগ নিয়ন্ত্রনের কাজে দায়বদ্ধ।  পিরামিডের চতুর্থ স্তরে আছে (DH) জেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র।  স্বাস্থ্য সেবা পিরামিডের এই স্তরই প্রথম স্তর যেখানে রয়েছে থিয়েটার সুবিধা, কিন্তু কিছু নির্বাচিত UHC তে রয়েছে EOC সুবিধাও।  পরিশেষে, পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মেডিকেল কলেজ এবং স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা যেখানে বিস্তৃত বিশেষায়িত সেবা পাওয়া যায়।  (২)

কার্যকর স্বাস্থ্য সেবা কিছু মৌলিক মাত্রার সাথে সম্পৃক্ত:

১) শারীরিক প্রবেশযোগ্যতা (দুরত্ব, ভ্রমন সময় এবং ভ্রমন ব্যয়)

২) অর্থনৈতিক প্রবেশযোগ্যতা ( ঔষধ খরচ, পরামর্শ খরচ, হাসপাতালে ভর্তি ব্যয়, বিবিধ পরীক্ষা-নিরিক্ষা সম্পর্কিত ব্যয়)

৩) সামাজিক ও কৃষ্টিগত অনুসঙ্গ যা প্রবেশযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে;

৪) সেবার অনুভুত গুনগতমান

– চিকিৎসকের সহজলভ্যতা

– ঔষধের সহজলভ্যতা

– চিকিৎসক/ নার্সের মনোভার

অন্য দিকে তথ্য সহজলভ্যতা বোঝায় যে সেবার উত্স, ধরণ ও গুনগত মান সম্পর্কে মানুষের অবশ্যই অবগত অভিমত/পছন্দ থাকা চাই।  কিন্তু যে রোগীর উচুঁ পর্যায়ের স্বাস্থ্য সুবিধা (জেলা হাসপাতাল, অধ্যাপনা হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল) পরিদর্শন করে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে তাদের দীর্ঘক্ষন অপেক্ষা করতে হয়: বিশেষায়িত হাসপাতালের বহির্বিভাগীয় রোগীদের অপেক্ষা সময় ছিল সর্বোচ্চ (৮২ মিনিট),  অধ্যাপনা হাসপাতালে  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৬৫ মিনিট), সর্ব নিম্ন (৫৮ মিনিট) ছিল জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে।  (২)

 “অর্থনৈতিক প্রবেশযোগ্যতা” মানে বোঝায় যে স্বাস্থ্য সুবিধা, জিনিসপত্র ও সেবা সমূহ (ঔষধ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র) সবার জন্য হতে হবে সাশ্রয়ী মূল্যে।  অসহায় জনসাধারণ যাদের যোগ্যতা সম্পন্ন বেসরকারি চিকিত্সকের পরামর্শ পাওয়ার সামর্থ নাই তাদের কাছে সরকারি সুবিধা সমূহই একমাত্র উপায়।  কিন্তু প্রমানের ভিত্তিতে দেখা যায় যে যদিও সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও, সাথে আরো কিছু আনুসাঙ্গিক খরচ সহ রোগীদেরকে ঔষধ খরচ এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার খরচ বহন করতে হয়। 

গড় প্রত্যক্ষ ব্যয় বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালের রোগীদের চেয়ে বেশী উপার্জন বা উত্পাদনশীলতা ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে।  (৫)

দুর্নীতি: স্বাস্থ্য সেবা অধিকারের অন্তরায়

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি’র উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টিবিধান এবং দরিদ্রদের পরিবার কল্যাণ পরিস্থতি, অবহেলিত এবং দেশের অতি দরিদ্রদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের যোগান দেয়া।  প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এস সেবা সমূহের যোগান দিচ্ছে (কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপ-কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র), দ্বিতীয় পর্যায়ে (জেলা সদর হাসপাতাল) এবং তৃতীয় পর্যায়ে (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল)।  

বিভিন্ন কর্মসূচী চালু এবং উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন সত্ত্বেও অনিয়ম এবং দুর্নীতি এখনো বিদ্যমান। 

বাংলাদেশের সংবিধান সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করলেও রোগীদের জন্য কোন আলাদা অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি।  অনুচ্ছেদ ১৫ (ক) এবং ৩২ বলে-“ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগনের জীবনযাত্রার বস্তুগত এবং সংস্কৃতিগত  মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন যাহাতে নাগরিকের জন্য নিম্ন লিখিত বিষয় সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়ঃ (ক) অন্ন, বস্ত্র আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (৩২) আইনানুযায়ী ব্যতিত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত করা হইবে না”।

ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত ৭তম দুর্নীতিগ্রস্থ খাত।  সামগ্রিকভাবে দেশের ৬৬.৫% পরিবার দুর্নীতি প্রভাবের শিকার যেখানে স্বাস্থ্য খাতে শিকার ৪২.৫% যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৭.৫% । 

TIB’র National Household Survey অনুযায়ী সরকারি স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি ৬৩.৩% পরিবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করে।  Health Bulletin 2015 of the Directorate General of Health Services (DGHS) অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০.৩% চিকিৎসক বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত।  বিগত চার দশক ধরে নিবন্ধনকৃত বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে- ১৯৮৩ সালের ৩৩টি থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫,৬৯৮টিতে। 

যাইহোক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কতিপয় অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ বহু গণমাধ্যম রিপোর্ট এবং গবেষণা অনুসন্ধানে প্রকাশিত হয়েছে, প্রসঙ্গত যা অধিক চিকিৎসা খরচ, রোগের ভুল নির্নয়, কমিশন ভিত্তিক সেবা, নিবন্ধনহীন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র পরিচালনা এবং সর্বোপরি প্রত্যাশিত স্বাস্থ্য সেবায় গুনগতমানের অভাব ইত্যাদি।  ব্যাপক অনুসন্ধামূলক গবেষণার অভাব রয়েছে এই খাতে যদিও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার মানের প্রশ্নে প্রচুর গবেষণা আর আলোচনা বিদ্যমান আছে।

স্বাস্থ্য সেবা গ্রাহকেরা জানান যে কিছু ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পূর্ণ সময়ের জন্য চিকিৎসকের সাপোর্ট পাননি, বিশেষ করে রাতের বেলা যখন মেডিকেল সেবা জরুরী হয়ে পড়ে।  অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতার সময়ে কোন ডাক্তার পাওয়া যায়নি অথবা সাক্ষাৎ মেলেনি উপজেলা, জেলা পর্যায়ের ডাক্তারদের যেহেতু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা দু’এক দিনের জন্য এলাকার বাইরে থেকে পরামর্শ দিতে আসে। 

TIB’র অনুসন্ধান এবং স্পষ্ট ঘটনা প্রবাহ প্রকাশ করে যে কয়েক দশক ধরে একটি কমিশন ভিত্তিক বাজার প্রক্রিয়া গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য সেবা খাতে।  সরকারি আর বেসরকারি ডাক্তার, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, গ্রাম ডাক্তার, ঔষধ ব্যবসায়ী, (ফার্মেসী মালিক), ঔষধ উত্পাদনকারী, ধাত্রী, বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের রিসিপশনিস্ট, রিক্সাওয়ালা এবং পেশাদার দালালদের মাঝে অবৈধ আতাঁতের খপ্পরে পুরো স্বাস্থ্য সেবা খাত।  অভিযোগ আছে যে, বেসরকারি সুবিধায় সেবা গ্রহীতাদেরকে অনেক সময় জোরপূর্বক অতিরিক্ত ঔষধ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে, আর অবশিষ্ট গুলো পরবর্তীতে বাইরে বিক্রি করা হয়। 

কমিশন চেইনে সম্পৃক্তদের ২৫% থেতে ৫০% লভ্যাংশ দেওয়া হয়।  এমন কি C-section কেস পাঠানোর জন্যও দেয়া হয় কমিশন যা ৫০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হয় থাকে।  অভিযোগ করা হয় যে, স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতাদেরকে পেশাদার দালালদের কর্তৃক হয়রানি হতে হয় যখন দালালরা ভুল তথ্য দিয়ে বা জোর করে রোগীদের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে চায়।  অশিক্ষিত বা অসচেতন রোগীদের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে বেশি।  (১১)

সার্ভে অনুসারে ২০১৫ সালে ৮৬.১% পরিবার স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে ৫৬.৬% সরকারি সুবিধা থেকে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেছে, ৬৩.৩% স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেছে বেসরকারি সুবিধা থেকে, ০.১% করেছে দেশের বাইরে থেকে এবং ০.৯% স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেছেন বেসরকারি সংস্থা (NGOs) থেকে।  যে পরিবার সমূহ যারা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেছে তাদের মাঝে ৩৭.৫% বিভিন্ন রকমের অনিয়ম আর দুর্নীতির সম্মুখিন হয়েছে। 

সেবা গ্রহণকারী পরিবারের মধ্যে ১৬.৭% পরিবারকে ঘুষ বা অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে, ১৩.৮% পরিবার ঔষধ সম্পর্কিত অনিয়মের মুখোমুখি হয়েছে, ৬.২% পরিবারকে বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা রোগ নির্নয় কেন্দ্র রেফার করা হয়েছে, ৪.৮% পরিবার প্রয়োজনের মুহুর্তে চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগ করেছে, এবং ১.২% পরিবার স্বাস্থ্য সেবা গ্রহনের সময় ঔষধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছে।  গড়ে প্রতিটি পরিবারকে ১৯৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সার্ভে মতে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পর্যায়ে ৩৮%, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যায়ে ৩৫.১% , জেলা সদর হাসপাতালে ৩৩.৬% পরিবার বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতির মুখোমুখি হয়েছে।   মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে যা ১৮.৯% এবং উপজেলা পর্যায়ে ১৮.৬%। 

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিশোধিত টাকার পরিমান গড়ে ২৮৩, আর সবচেয়ে কম ঘুষ পরিশোধিত হয় কমিউনিটি ক্লিনিকে যার গড় পরিমান ৩১ টাকা। 

দুর্নীতির শিকার পরিবারকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় হাসপাতালের ট্রলি আর হুয়িল চেয়ার ব্যবহারের জন্য যা ৫৩.৭%, ব্যান্ডেজ আর ড্রেসিং সেবার জন্য ২৬%, অস্ত্রোপচার সেবার জন্য ১৬.৫%, মাতৃত্ব সেবার জন্য ১৪.৯%, টিকেট ক্রয়ে ১১.৯%, রোগ নির্ণয়ের জন্য ১০.৮% এবং সাধারণ/কেবিন এবং ভাড়ায় বিছানা পেতে ৭.৪% পরিবারকে ঘুষ প্রদান করতে হয়।

গড়ে প্রতিটি পরিবারকে অস্ত্রোপচার সেবার জন্য মোট ১,১৬৮ যা অনেকটা মাতৃত্ব সেবার কাছাকাছি, ১,১৪৫ টাকা। 

 ঘুষ সংক্রান্ত দুর্নীতি শহুরে চিকিৎসা কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিভাগ সেবাকে অঁচল করে দেয়।  এক প্রতিবেদনে বলে যে কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি বিচানা পাইয়ে দিতে বছরে প্রায় ৪ মিলিয়ন টাকা ঘুষের লেনদেন হয়।  প্রতিবেদনটি একটি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী চক্রকে চিহ্নিত করে যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গুরুপূর্ণ শাখা নিয়ন্ত্রন করে, এবং তারা নিশ্চিত করে যেন লেনদেন ছাড়া কোন ধরনের জরুরী সেবা না দেয়া হয়।  প্রাথমিক, জেলা এবং তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে একই পরিস্থতি, যেখানে সময়মত চিকিৎসকের পরিদর্শন, স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রয়োজন হয় টিকেট ক্রয়ের, রোগীর জন্য বিছানা এবং প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কিনতে হয় একটি সংগঠিত গ্রুপের মাধ্যমে। 

সর্বোচ্চ ৪৪.৪% পরিবার ঘুষের লেনদেন করে কারণ ঘুষ ব্যতিত সেবা পাওয়া অসম্ভব, ৩৯.৬% পরিবার অতিরিক্ত অর্থের লেনদেন করেছে কারণ চিকিৎসা ফি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিলনা, ২৪.৩% পরিবার ঘুষ দিয়েছে সময়মত সেবা পাওয়ার জন্য, ২৩.২% লেনদেন করেছে যথাযথ সেবা পাওয়া এবং ১১.২% পরিবার ঘুষ দিয়েছে ঝামেলা মুক্ত থাকার জন্য। 

আরেক গবেষণায় দেখা যায় ৬৫% রোগীকে অনুপযুক্ত ( অথবা সম্ভাব্য অনুপযুক্ত) ঔষধ বা অনুপযুক্ত মাত্রা, সেবনের পুনরাবৃত্তি এবং সেবন কাল প্রেসক্রাইব করতে দেখা যায়।  গবেষণাটি বলে যে একটি প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পর রোগীদের প্রাইভেট ফার্মেসী থেকে ঔষধ ক্রয়ের পরামর্শ দেয়া হয়, অনুশীলনটি যে কেবল চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য করা হয় তা পরিস্কার।  ব্যবস্থাপত্রে নির্বাচিত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর ঔষধ নির্দেশ করার কারণে প্রণোদনা হিসেবে ডাক্তারেরা মাসিক প্রদেয়, বিমান টিকেট, মোবাইল ফোন বিল ইত্যাদি বহুবিধ পুরস্কার পেয়ে থাকে।  এধরনের কার্যক্রম আইনত অবৈধ। 

সরকারি হাসপাতালে ড্রাগ এবং সরঞ্জামে আরেক দুর্নীতির প্রমান আবির্ভূত হয়েছে।  TIB’র এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে দেশের সবচেয়ে বড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৫% অভ্যন্তরীণ এবং ৬৮% বহির্বিভাগীয় রোগী কিছু পরিমানে বিনামূল্যে ঔষধ গ্রহণ করেছে।

চতুর্থ শ্রেণীর এবং নিম্ন পদবীর সরকারি কর্মচারীর যে দামী ঔষধ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে তা প্রমানযোগ্য।  রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ দেওয়ার জন্য মনোনিত ফর্ম রয়েছে।  চিকিৎসকেরা যাদের এই ফর্মে ঔষধের ব্যবস্থাপনা করবে কেবল সেই রোগীরাই বিনামূল্যে ঔষধ পাওয়ার যোগ্য।  অসৎ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা এই ফর্মগুলো চুরি করে ঔষধ পাচারের সাথে সম্পৃক্ত।  চুরি করার পর তারা ফর্মে ঔষধের নাম লিখে চিকিৎসকের সাক্ষর নকল করে স্টোর থেকে ঔষধ উত্তোলন করে বাইরের ফার্মেসীতে বিক্রি করে। 

গবেষণায় দেখা যায় যে সরকারি সুবিধায় ভর্তি হওয়া একটি সুদীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।  

১০% রোগীর প্রভাবশালী ব্যক্তির (আমলা, রাজনৈতিক নেতা, এমপি ইত্যাদি)  সুপারিশের প্রয়োজন দেখা গেছে আরেক গবেষণায়।  গবেষণায় আরো পাওয়া যায় যে, দরিদ্রদের যেহেতু হাসপাতালে পরিচিত বা সংযোগ কম এবং প্রভাবশালীদের কাছ থেকে সুপারিশও পাওয়ার সম্ভাবনা কম তাই বেশিভাগ ক্ষেত্রে তাদের অবৈধ লেনদেনের আশ্রয় নিতে হয়।

অন্যদিকে কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকার অভ্যাস প্রসঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য দুটি সমস্যা রয়েছে।  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটা হলো সরকারি হাসপাতালের অনেক পদ কখনোই পূর্ণ হয়না যার কারণে এসব পদগুলো শুন্যই রয়ে যায়।  অন্য সমস্যাটি হলো ডাক্তারের দায়িত্বে অনুপস্থিত থাকার কারণে কখনো শুন্য স্থানটি পূর্ণ হলেও চিকিৎসকেরা রোগী দেখে না।  এই অনুপস্থিত কর্মচারীরা ঠিকই সময়মতো তাদের ভাতা গ্রহণ করেন, কিন্তু কর্মস্থলে উপস্থিতিতে অনিয়মিত।  যদি না চিকিৎসক এবং অন্যান্য সেবা প্রদানকারীরা চাকরীতে উপস্থিত থাকে, তাদের উপর অঙ্গিভূত ব্যয়ও উদ্দেশ্য প্রণীত সুবিধাভোগীর নিকঠ পৌঁছায় না।

“চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির হারই সবচেয়ে বেশী, ৪০%।  সুযোগ-সুবিধার পর্যায়কে আলাদা করলে দেখা যায় বড় হাসপাতালে অনুপস্থিত চিকিৎকদের হার ৪০% এর বেশী কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট উপ-কেন্দ্র সমূহ যেখানে কেবল একজন ডাক্তার রয়েছে সেখানে এর হার ৭৪%। 

ক্লিনিকে কর্মী ধরে রাখা কেনো এত কঠিন? একটি ধারণা এই যে সাধারনত উন্নয়শীল দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, অধিকাংশ মেডিকেল চিকিৎসকেরা শহরে জন্ম গ্রহণ এবং বেড়ে উঠে, বৃহত্তর জনগোষ্টির তুলনায় তারা উচ্চ শিক্ষিত, এবং তারা যে দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠে তা অত্যান্ত বাজারজাতযোগ্য এবং লোভনীয়।  সবমিলিয়ে, তারা মফস্যল এলাকায় বসবাস করতে প্রত্যাশী নই”।

বাংলাদেশ সরকার চিকিৎসকদের জন্য ২০,২৪৩টি পদের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে ১১,৩০০টি পদ বর্তমানে পূর্ণ যার এই যে মোট ৪৪.২% পদ শুন্য।  অনুমোদন পাওয়া ১৭,১৮৩ পদের মধ্যে বর্তমানে মোট ১৩,৪৮৩ জন নার্স দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজ করছে।  বিভিন্ন পর্যায়ে শুন্য পদের জন্য নার্সের বন্টন প্রক্রিয়ায় দেখা যায় যে, প্রায় ৯৬% সিনিয়র নার্সের পদ এখনো খালি।   সবচেয়ে বেশী শুন্য পদ লক্ষ্য করা গেছে বরিশালে (৬৪.৯), খুলনায় ৫৮.২%, রাজশাহীতে ৫৫.৩%, সিলেটে ৫৪.৭ %, চট্টগ্রামে ৫০.৭% এবং ঢাকায় ২৫.৪%।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে যাদের ১৭টির ২,৫০৯জন চিকিৎসক এবং অবশিষ্ট্য ৩টি ২১০জন ডেন্টিস্ট তৈরি করতে সক্ষম।  ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো মোট ১০,৯৯০জন চিকিৎসক তৈরি করতে সমর্থ হয়, যার ৪৯.২% মহিলা।

১৯৯০এর দশক থেকে দেশে মেডিকেল শিক্ষার সুযোগ সরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের বাইরে প্রসারিত হচ্ছে।  ৪৪টি মেডিকেল কলেজ মিলে মোট ৩,৩৩৫জন চিকিৎসক তৈরি করতে সমর্থ।  ১২টি ডেন্টাল কলেজের ৭৭০জন ডেন্টিস্টকে শিক্ষা দেওয়ার সামর্থ রয়েছে।  বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মোট ৫৩০জন নার্স, ১৪০জন ধাত্রী এবং ১,৮৫৫জন মেডিকেল সহকারীকে স্নাতক প্রদান করা হয়।

সীমিত সম্পদ, প্রয়োজনীয় ঔষধ ও সরঞ্জামের স্বল্পতা এবং রোগীর বিপরীতে চিকিৎসক এবং নার্সের অস্বাভাবিক অসামঞ্জস্য হার- এসবই হলো বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার বাস্তবতা। 

সার্ভে অনুসন্ধান উদ্ঘাটন করে যে, একজন বহির্বিগীয় রোগী গড়ে ৯০.১টাকা ব্যয় করেছে, যেখানে একজন অভ্যন্তরীণ রোগী ব্যয় করেছেন গড়ে ২,৪৭৭.৫ টাকা।  জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে একজন বহির্বিগীয় রোগী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাল কেন্দ্রের চেয়ে গড়ে ৬গুন ব্যয় করে।  একইভাবে, জেলা হাসপাতাল পরিদর্শন করা একজন অভ্যন্তরীণ রোগী উপজেলা পর্যায়ের একজন অভ্যন্তরীণ রোগীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুন টাকা ব্যয় করে। 

থামুন আপনার স্বাস্থ্য অধিকার জানুন

অর্থনৈতিক বোঝা আছে, রয়েছে দুর্নীতি কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে এসবের শিকার হয় যারা তাদের অধিকার নিয়ে পর্যাপ্ত আইন নাই এ দেশে।  দরিদ্র রোগীরা রীতিমত রয়েছে উভয় সংকটে।  রোগীদের জন্য এটি একটি নিয়মিত বন্ধীদশা।  মেডিকেল পোশাজীবি কর্তৃক স্বাস্থ্য পেশাদারী অবহেলার শিকারের ক্ষেত্র রোগীর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট কোন আইনী ব্যবস্থা নাই।

অধিকাংশ দেশে চিকিৎসা অবহেলাকে সাধরণভাবে একটি অভিযোগ্য দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে দেখা হয় অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরনই যার সচরাচর প্রতিকার।  সাধারণ আইন ব্যবহার শাস্ত্রে এটি অপরাধ আইনের আওতায় আসে।  কোন কোন দেশ এই ব্যাপারটি অপরাধ আইনের আওতায় এনে বিচার করে, যেমন মালেয়শিয়া; আবার কোন কোন দেশে এমন অপরাধ প্রতিকার করতে নির্দিষ্ট জুডিশীয়াল আদালত সহ আলাদা আইন প্রনয়ণ করে, যেমন ভারতে মেডিকেল অবহেলার মামলা সমূহ ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় এনে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।

মেডিকেল অবহেলা বা অসৎ আচরণ অনেক সময় ফৌজদারী অপরাধেরও জন্ম দেয়।  এমন অপরাধ সমূহ সাধারনত দেশের ফৌজদারী আইনের মাধ্যমে বিচার করা হয়।

মেডিকেল অবহেলার ইস্যুটি একটি গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ যা সরাসরি জীবন ধারণের অধিকার এবং স্বাস্থ্য সেবা অধিকারকে প্রভাবিত করে।  বাংলাদেশে মেডিকেল অবহেলার অহরহ ঘটনার অধিকাংশই কোন আইনি শাস্তি ছাড়া পার হয়ে যাচ্ছে, যা হতাশজনক পরিস্থতির দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখানে মেডিকেল সেবা প্রদানকারীদের উপর সার্বজনীন বিশ্বাস সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।  যদিও বিদ্যমান আইনের অধিনে প্রাপ্য আইনানুক প্রতিকার সীমিত বা প্রবেশে কঠিন, এমন প্রয়াস বিদ্যমান আইনের অক্ষমতা এবং বিচার পদ্ধতিতে বিদ্যমান সমস্যাদি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দেয়।  

সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে সচরাচর অসদাচরণে হাজার হাজার আঘাত আর মৃত্যুর কারণ উদ্ধিগ্নতার কারণ হয়ে উঠছে।  অপ্রতুল ঔষধ এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সাথে সবকিছুর মূল্য পরিশোধ করেও সাধারণ মানুষ যথাযথ চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।  জনসাধারণকে স্বাস্থ্য পেশাজীবি কর্তৃক মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনুপযুক্ত চিকিৎসা, অশোভ আচরণ এবং অমানবিক ব্যবহারের তারা যেন উত্কৃষ্ট সত্বা এবং যারা এদের নিকঠ চিকিৎসার জন্য ধারস্থ হয় তারা নিম্ন সত্বা যাদেরকে চাইলেই অপব্যবহার করা যায়। 

বাংলাদেশের সংবিধান স্বাস্থ্য সেবা অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং জীবন ধারণের অধিকার নিশ্চিত করে।  বাংলাদেশ বহু সংখ্যক আন্তর্জাতির দলিলেরও অংশীদার যার আওতায় সরকার স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষা এবং বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। 

অনেককে প্রতিদিনই অপব্যবহার সহ্য করতে হয় এবং মাঝে মাঝে দেশে চিকিৎসার কারণে বা স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীদের অবহেলার কারণে মানুষ মারা যায়।   বিদ্যমান আইন এই পেশাদারী অবহেলা নির্ধারনে কোন বৈধ প্রতিকার নাই।  কার্যকরী আইনের প্রয়োগের অভাবে মেডিকেল পেশাজীবিরা তাদের পেশাদারীত্ব নিরাপত্তার সুযোগ নিচ্ছে। 

আইন ও শালিশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এটা নিশ্চত হওয়া যায় যে ১৯৯৫ সাল থেক ২০০৮ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০৪ টি মেডিকেল অবহেলা সম্পর্কিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বা রোগী অঙ্গপত্যঙ্গ হারিয়েছে।  আইন ও শালিশ কেন্দ্র আরো জানায়, এই সংখ্যাটি আরো বড় হতে পারে যদি সমস্ত ঘটনাকে আমলে নেয়া যেত, এবং যদি অপ্রকাশিত ঘটনাগুলোকেও হিসাব করা যেত।

বাংলাদেশে রোগীরা সবচেয়ে অবহেলিত ভোক্তা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।  রোগীদের অধিকার নিয়ে কখনো ভাবা হয়নি বা গুরুতরভাবে বিবেচনা করা হয়নি।  স্বাস্থ্য সেবা পেশাজীবিদের ভূমিকাকে কেবল অর্থ-পয়দাকারী কারখানা হিসেবে দেখা হয়েছে আর রোগীদের ভাবা বা গণ্য করা হয়েছে স্বাস্থ্য সেবার ভোক্তারুপে।

স্বাস্থ্য সেবা কারখানার প্রবনতা বা স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী পদ্ধতির আবির্ভাব হয়েছ ‘ চিকিৎসকদের উদ্ধোক্তা বা কোন ব্যবসায় উদ্ধোগের কর্মী যারা পারস্পরিক প্রতিযোগিতার জালে আটকা পড়েছে”। 

মেডিকেল বৈশিষ্ট্যের আওতায় পড়েনা স্বাস্থ্য পেশাজীবিদের এমন আচরণকে মেডিকেল অবহেলা হিসেবে সজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।  অন্য অর্থে মেডিকেল অবহেলা হলো কোন কাজের মাধ্যমে অবহেলা বা একজন স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর ভ্রান্তি যেখানে প্রদানকৃত সেবা মেডিকেল পেশাজীবি জনগোষ্টিতে গ্রহযোগ্য মান থেকে বিচ্যুৎ এবং মেডিকেল সম্পর্কিত ত্রুটি কারণে রোগীর ক্ষতি বা মৃত্যুর কারণ হয়।  এটি একজন চিকিৎসকের তাঁর কর্তব্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে দায়িত্ব লঙ্গন।

অবহেলা যেহেতু কোন সেবার দায়িত্বের লঙ্গন তাই এই দায়িত্বের লঙ্গন একজন রোগীকে অবহেলার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার দেয়।  সকল মেডিকেল পেশাজীবি, ডাক্তার, নার্স, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সবাই তাদের রোগীর স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেবা প্রদানে প্রত্যাশিত।  দুর্ভাগ্যবশতঃ, মেডিকেল পেশাজীবি এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীরা তাদের রোগীদের প্রত্যাশিত সেবা এবং মনোযোগ না দেয়া, বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ বা নিম্ন মানের সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে বঞ্চিত করতে পারে যা তাদের সুদুরপ্রসারী জঠিলতা বাড়িয়ে দেয়ার কারণ হয়ে ব্যক্তিগত ক্ষতি এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। 

অপর্যাপ্ত দক্ষতা, সেবা, বা গতি মেডিকেল অবহেলার সত্ত্ব দাবির কারণ হতে পারে।  ডাক্তার, নার্স বা বিশেসজ্ঞ সহ যে কোন ব্যক্তি যে একজন রোগীর স্বাস্থ্য সেবার যে কোন অংশের ভার গ্রহণ করে তাকেই মেডিকেল অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত করা যেতে পারে।  যে পেশাজীবিরা মনস্তাত্ত্বিক সেবা প্রদান করে তারাও রোগীর সুস্থতার জন্য দায়বদ্ধ এবং পেশাজিবি অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে। 

রোগের ভুল নির্নয়, বিলম্বিত নির্নয় অস্ত্রোপচারে ত্রুতি, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার, এ্যানেস্টেসিয়ায় ভুল, এ্যানেস্টেসিয়ায় অবহেলা, এ্যানেস্টেসিয়াজনিত কর্মক্ষমতা পরিদর্শনে ব্যর্থ হওয়া, ভুল অস্ত্রোপচার, চিকিৎসায় অবহেলা, এবং গর্ববতী মহিলাদের C-section, কষ্টসাধ্য প্রজননে দুর্ব্যবহার, প্রনোদিত প্রসববেদনার সহিত জটিলতা, দীর্ঘমেয়াদী অবহেলিত চিকিৎসা মেডিকেল অসদ আচরণ বা অবহেলার আওতায় পড়ে। 

মেডিকেল অবহেলা বা অনেক খবর অপ্রকাশিত রয়ে যায় কারণ, “ বহু দরিদ্র শ্রেনী থেক আসা রোগী যারা এই মেডিকেল অবহেলা বা অবমাননার স্বীকার হয় তারা মনে করে এটা তাদের পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা ভাগ্য।  বতারা খুব কমই এর প্রতিকার চাই এবং এমনকি যদিও কখনো কোন ভোক্তভুগীর দ্বারা প্রতিকার চাওয়া হলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার পরিণতি হয় নেতিবাচক যার কারণে ভোক্তভুগীর জন্য পরিস্থিতি হয়ে উঠে আরো খারাপ।

আইন ও শালিশ কেন্দ্রের মতে, অভিযুক্ত অপরাধের প্রকৃতি এবং মাত্রার উপর নির্ভর করে মেডিকেল অবহেলা বা দুর্ব্যবহার এবং চিকিৎসা পোশা বা সেবাকে কেন্দ্র করে প্রতারণা বা অবৈধ অনুশীলনও সাধারণ ফৌজদারী আইনের আওতায় আসে।  বাংলাদেশে ফৌজদারী আইনের কেন্দ্রবিন্দু হলো ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি যা সাধারণত ফৌজদারী অপরাধ সমূহ রায়ের কার্যে ব্যবহৃত হয়। 

রোগী বা ভোক্তভুগির প্রতি ঘটিত ক্ষতির নিরুপন মেডিকেল অবহেলা ঘটিত মামলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ।  ক্ষতি বাস্তবিক হওয়া চাই এবং বেশি দুরবর্তী হলে চলবে না।  নিম্ন লিখিত উপায়ে ক্ষতি নির্নয় করা যেতে পারে-

(১) অবহেলার ফলে সংঘটিত চিকিৎসা জটিলতার জন্য অতিরিক্ত অর্থনৈতিক খরচ

(২) অবহেলার দরুণ দৈনন্দিন কাজে অনুপস্থিতির কারণে ক্ষতি

(৩) আয়ুস্কালের ক্ষয়

(৪) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো

(৫) পরিবারে উপার্জনকারী রোগীর মৃত্যু

(৬) সঙ্গ হারানো ইত্যাদি

অপরাধের পরওয়ানা দাবি করে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারী অভিযোগ দন্ডবিধির ৩০৪(ক) এর আওতায় শাস্তিযোগ্য-

৩০৫ (ক): কোন ব্যক্তি যদি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনকভাবে কর্মের দ্বারা কারো মৃত্যু ঘটায় তা শাস্তিযোগ্য নরহত্যা বলে বিবেচিত হবে না, তবে সে ব্যক্তি পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে, অথবা অর্থ দন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।

৩৩৬: যে ব্যক্তি এমন বেপরোয়াভাবে বা অবহেলামুলকভাবে কোন কার্য করে, যার ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হয় বা অন্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হয়, তবে উক্ত ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে, অথবা দুইশত পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত যে কোন পরিমান অর্থ দন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

৩৩৮ (ক) : যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ কর্তৃক কাউকে গুরুতরভাবে  আহত করে, যে কাজটি এতই বেপরোয়া বা অবহেলামুলক যে তার ফলে মানুষের জীবন সঙ্কিত করে বা নিজের বা অন্যের জীবনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হয়, তাহলে সে দুই বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে, বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত যে কোন পরিমান অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবে। 

১৮৬০ সালের ফৌজদারি আইন চিকিৎসকদের বেপরোয়া বা অবহেলার কারণে জীবন বিপন্ন বা রোগীর মৃত্যুর বিভিন্ন মাত্রার ক্ষতি দাবি করে।

মেডিকেল সেবা প্রদানকারীদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইন ২০০৯ এর অধিনে অভিযুক্ত করা যেতে পারে।  ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইনের ৪৫ ধারা মতে, “কোন ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”।  একই আইনের ৫২ ধারা অনুযায়ী, “কোন ব্যক্তি, কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত বিধি-নিষেধ অমান্য করিয়া সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে পারে এমন কোন কার্য করিলে, তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”।

 উল্লেখিত আইনানুসারে যে কেউ ভোক্তার জীবন ও নিরাপত্তা বিপন্ন করে এমন কাজ করে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

বাংলাদেশে যদিও রোগীদের রক্ষায় কোন সুস্পষ্ট আইন নই, তবুও উপরোল্লেখিত ধারা সমূহ কিছুটা হলেও সানত্বনার কারণ হতে পারে।  উপরে বর্ণিত মেডিকেল সেবা সম্পর্কে দুর্লভ, অবহেলা, অসুস্থতার চিকিৎসা না পাওয়া ঘটনা সমূহের মাধ্যমে এটা নিশ্চয় পরিস্কা হয়ে গেছে যে কেন সুস্বাস্থ্য নিয়ে এটকু বেশী দিন বেঁচে থাকার চেষ্টা করাটা অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে।  রোগীদের জন্য-বলতে গেলে দেশের দরিদ্র শ্রেণীর জনসাধারণের জন্য উদ্বেগমুক্ত স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য সেবা এবং বেঁচে থাকার বিষয়ে দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য-নীতিতে সেই সুযোগ নেই। 

এই প্রবন্ধটিতে সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নিকট কোন ধরনের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত নই।  এটা বরং কিভাবে সাধারণ অর্থনৈতিকভাবে দুঃস্থ মানুষগুলো স্বাস্থ্য সেবা যা নেহায়াতই তাদের জন্য তার বোঝার নিচে আটকা পড়ে আছে সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য।  কর্তৃত্বপূর্ণ মেডিকেল পেশাজীবিদের দ্বারা ক্রমাগতভাবে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারকে অবহেলা করা হচ্ছে বহুকাল ধরে।  স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যয় করতে অসমর্থ হওয়া মানে এই নই যে তার জন্য কেউ তার জীবন ধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। 

বাংলাদেশে চলমান নির্বাচকধর্মী স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা প্রমান করে যে কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত এবং সামর্থ মানুষেরই বেচে থাকার অধিকার আছে।  এটা খুবই স্ব-প্রমান্য যে যদি অসুস্থতা তাকে পেয়ে বসে এই প্রবন্ধের লেখক নিজেই তার ভবিষ্যৎ শারীরিক সুস্থতা এবং সম্ভাব্য বেচে থাকার বিষয়ে অনিশ্চিত।  স্বাস্থ্য সেবায় উঁচু মাত্রায় খরচ বহন করতে অসমর্থ গরিবেরা।


প্রবন্ধটি ইংরেজিতে পড়ুন এখানে

সূত্র সমূহ:

1. Bangladesh Health Watch Report 2011. Watch, Bangladesh Health.

2. Access to Public Health Facilities in Bangladesh: A Study on Facility Utilisation and Burden of Treatment. MANNAN, M. A. s.l. : Bangladesh Development Studies, 2013, Vol. Vol. XXXVI.

3. Health for All in Gujarat: Is It Achievable? MAHADEVIA, DARSHINI.

4. Organization, World Health. The Right to Health. Geneva, Switzerland: Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights and WHO.

5. Cost of illness for outpatients attending public and private hospitals in Bangladesh. Md Sadik Pavel, Sayan Chakrabarty and Jeff Gow. 2016.

6. Healthcare use and expenditure for diabetes in Bangladesh. Sheikh Mohammed Shariful Islam, Andreas Lechner, Uta Ferrari, Michael Laxy, Jochen Seissler, Jonathan Brown, Louis W Niessen, Rolf Holle.

7. Who pays for healthcare in Bangladesh? Analysis of progressivity in health systems financing. Chi, Azaher Ali Molla and Chunhuei.

8. Paying Out of Pocket for Healthcare in Bangladesh – A Burden on Poor? Nazmul M HUQ, Abul Quasem AL-AMIN, Sushil Ranjan HOWLADER, and Mohammad Alamgir KABIR.

9. Deepening Health Insecurity in India: Evidence from National Sample Surveys since 1980s. SAKTHIVEL SELVARAJ, Anup Karan. 2009.

10. Corruption in Service Sectors: National Household Survey 2015. Bangladesh, Transparency International. s.l. : Transparency International Bangladesh.

11. Private Healthcare:Governance Challenges and Way Out. Julkarnayeen, Taslima Akter and Muhammad. s.l. : Transparency International Bangladesh (TIB), 2017.

12. Jonathan Rose, Tracey M. Lane and Tashmina Rahman. BANGLADESH: GOVERNANCE IN SECTORS, Bangladesh Governance in the Health Sector: A Systematic Literature Review. 2017.

13. Ghost Doctors: Absenteeism in Bangladeshi Health Facilities. Hammer, Nazmul Chaudhury and Jeffrey S. 2003.

14. Negligence in Government Hospitals of Bangladesh: A Dangerous Trend. Farid, Md. Rabiul Islam and Shekh. s.l. : Institute of Social Welfare and Research (ISWR), 2015.

15. Medical Negligence and Fraudulent Practice in Private Clinics: Legal Status and Bangladesh Perspective. (ASK), Ain o Salish Kendra. 2013.

16. Medical Negligence: A Review of the Existing Legal System in Bangladesh. Reza, Kazi Latifur. 2016, Vols. Volume 21, Issue 10.

17. Medical Negligence Laws and Patient Safety in Bangladesh: An analysis. Sheikh Mohammad Towhidul Karim, Mohammad Ridwan Goni and Mohammad Hasan Murad. Journal of Alternative Perspectives in the Social Sciences, Vols. Volume 5 No 2, 424-442.

The Wiki Queen

Doing the right things by the right living with the right people in the right manner.

Post a Comment

Previous Post Next Post